ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্ন্তবর্তী সরকার গঠনের পর প্রশাসনে ৫০১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১২ জন কর্মকর্তা। গ্রেড-১ পদোন্নতি পেয়েছেন ৩ জন। ১৩৫ জন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যুগ্ম সচিব পদে ২২৬ জন এবং উপসচিব পদে ১২৫ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্র জানায়, অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের বিগত তিন মাসের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের প্রতিবেদন চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। ৬ নভেম্বর স্বাক্ষরিত চিঠি বৃহস্পতিবার দুপুরে সব সচিবের দপ্তরে পাঠানো হয়। এতে মন্ত্রণালয়ের বর্ণিত সময়ে কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি, বদলি ও কতজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার তথ্য দিতে বলা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নতুন কী কী আইন/বিধি-বিধান তৈরী বা সংশোধন করা হয়েছে, কী কী নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এবং পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন এর জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা জানাতে বলা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ১৫ বছরে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। তবে তাদের সবাইকে এখনো যোগ্যতা অনুযায়ী পদায়ন করা হয়নি। এছাড়াও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সচিব পদে পদোন্নতির জন্য অতিরিক্ত সচিব পদে ১ বছর কাজ করতে হবে এমন অলিখিত বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা নিয়ে অনেক যোগ্য কর্মকর্তাকে সচিব পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যেতে হবে। এছাড়াও চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগেও সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্য। যোগ্য অনেক কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে বিসিএস ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের প্রধান্য দেওয়া হয়েছে।
বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছেন বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের মেধাতালিকায় প্রথম হওয়া ড. শেখ আবদুর রশিদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. এম এ মোমেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এহছানুল হক ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ, বিসিএস ৮৪ ব্যাচের সিদ্দিক যোবায়ের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং ৮৫ ব্যাচের এ এস এম সালেহ আহমেদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের ৮ জন বঞ্চিত কর্মকর্তাকে সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হলেও একই ব্যাচের সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় যোগ্য কর্মকর্তাকে এখন পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সদ্য নিয়োগ পাওয়া চুক্তিভিত্তিক সিনিয়র সচিবের মধ্যে বেশিরভাগই বিসিএস ৮২ ব্যাচের। ৮২ স্পেশাল ব্যাচের একজনকেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়নি। যদিও বিসিএস ৮২ স্পেশাল ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩৩ জন সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। সিনিয়র সচিব নিয়োগ পেয়েছিলেন ৫ জন কর্মকর্তা। সাবেক দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সাবেক মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এই ৮২ স্পেশাল ব্যাচের কর্মকর্তারা।
আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে ১৯৮৫ ব্যাচের ৬০ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব এবং ১৮৪ জন কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব পদ থেকেই পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে চাকরি থেকে অবসরে যেতে হয়। এই ব্যাচে ৪৮ জনের অধিক কর্মকর্তা সচিব এবং ১০ জনের অধিক কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। একইভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছিলেন ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারাও। এর পরের ১৯৮৬, ৯ম, ১০ম, ১১তম, ১৩তম ও ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও সচিব হয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত যুগ্মসচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া চারজন কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও বেশ কিছু কর্মকর্তা রয়েছেন যারা আওয়ামী শাসনামলে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। এর মধ্যে তথাকথিত উত্তরা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়ে দীর্ঘদিন ওএসডি থেকে অবসরে যাওয়া, গ্রেফতার হওয়া, ওএসডি থাকাকালীন সচিবালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়া, উচ্চতর গবেষণা কাজে নিযুক্ত থাকাকালে অনুমতি বাতিল করে ফিরিয়ে আনা কর্মকর্তাও রয়েছেন। এসব নির্যাতিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ৮২ বিশেষ ব্যাচের যুগ্মসচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া ড. আব্দুস সবুর, আব্দুল বারি, ৮৬ ব্যাচের আব্দুল মতিন, জাকির কামালসহ আরো অনেকে রয়েছেন। নির্যাতিত এসকল কর্মকর্তাদের কারও কারও বিষয়ে সরকারের বিবেচনাধীন থাকা সত্ত্বেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ের বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ এবং সহকারী একান্ত সচিব ড. সুরাতুজ্জামান প্রায় এক দশক ওএসডি থেকে অবসরে যান। ইতোমধ্যে একান্ত সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ দিলেও সহকারী একান্ত সচিব ড. সুরাতুজ্জামান এখনো কোনো পদোন্নতি পাননি। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর একান্ত সচিব ড. এম মাহফুজুল হককে পর্তুগালে রাষ্ট্রদূত পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার একান্ত সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়াকে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিপন্থী বঞ্চিত কর্মকর্তা এবং তথাকথিত উত্তরা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়ে দীর্ঘদিন ওএসডি থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদের একান্ত সচিব ড. আব্দুস সবুরকে পদোন্নতি বা পদায়ন করা হয়নি।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর গঠন হওয়া সরকারে এখনো বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। পদোন্নতি বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটছে। সরকারে থাকা একজন উপদেষ্টার সাথে যারা কাজ করেছেন অথবা তার সাথে আঞ্চলিক যোগাযোগ রয়েছে তাদেরকেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। যার প্রমাণ নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পিডিএস পর্যালোচনা করলেই পাওয়া যাবে। ১/১১ এ এই উপদেষ্টার সহযোগী এবং ওই সময়ের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদেরকেই তিনি মূল্যায়ন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এসআই/আইএ