ঢাকা : জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালিয়েছে পুলিশ। গুলি করে হত্যা করা হয়েছে সাধারণ ছাত্র ও নিরীহ লোকজনকে। যেসব পুলিশ সদস্য গুলি চালানো, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও ক্ল্যাশ গ্রেনেড ছুড়েছেন তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১৭১৭।
এই আন্দোলনেই পুলিশ প্রথমবারের মতো ক্ল্যাশ গ্রেনেড ব্যবহার করেছে। এটি মূলত ভিড় ও দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হিসেবে পরিচিত। পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
ওই সূত্রের তথ্যমতে, আন্দোলনকারীদের রুখতে মাঠে ১৪৭৯টি সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। এছাড়া ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৪ হাজার ২২৩ রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়া এই আন্দোলনেই পুলিশ প্রথমবারের মতো ক্ল্যাশ গ্রেনেড (ভিড় ও দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র) ব্যবহার করেছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এই গ্রেনেডটি ব্যবহার করা হয়েছে ২৭৪টি।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ডাকে। ওই দিন আন্দোলন নস্যাৎ করতে বেপরোয়া ছিল পুলিশ।
তিনি জানান, পুলিশ বিপুল পরিমাণ গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ঢাকায় তান্ডব চালানো হয় সবচেয়ে বেশি। এরপর চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশালে বেশি ঘটে। তবে যশোর ও গোপালগঞ্জে পুলিশ এক রাউন্ডও গুলি বা টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেনি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আন্দোলনের সময় ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ব্যবহারের যে হিসাব পাওয়া গেছে সেটা আরও বেশি হতে পারে। এসব হিসাব চূড়ান্ত করতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।
সূত্রমতে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বেশি সহিংসতা হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রাজশাহীতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশি বেপরোয়া ছিল ঢাকা মহানগর ও আশপাশের এলাকায়। এসব এলাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।
জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘নিরপরাধ ছাত্র-জনতাকে অপেশাদার পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যরা মিলে হত্যা করেছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
বলেন, ‘গত সরকারের সময় পুলিশের এসব কর্মকা- নিয়ে প্রায়ই প্রতিবাদ করতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছি। এখন সময় এসেছে পুলিশকে ঢেলে সাজানোর। এমন পুলিশ আমরা চাই, যারা হবে জনগণের পুলিশ। আশা করি, বর্তমান সরকার তা করতে পারবে।’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
৫ আগস্ট প্রবল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সরকারের অনেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও পালিয়ে যান। দেশ ছেড়ে পালান পুলিশের ঊর্ধ্বতন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। যারা দেশে ছিলেন তাদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজন, পুলিশ, আনসারসহ ৭৩৫ জন (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী) প্র্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করেছেন অনেকেই। গুরুতর আহত কয়েকজন চিকিৎসা নিচ্ছেন বিদেশে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘ক্ষমতায় টিকে থাকতে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে ব্যবহার করেছে। সর্বশেষ আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি করারও নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তাদের নির্দেশে পুলিশ নানা অপকর্মও করেছে।’
তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় পুলিশ প্রবিধান মানা হয়নি। যারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনায় সম্পৃক্ত, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাছাড়া পুলিশকে রাজনৈতিক কাজে যারা ব্যবহার করেছে তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত।
এমটিআই