ঢাকা: নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে চায় বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রবেশের বার্তা গেল জনগণের কাছে।
অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন।
দায়িত্ব পাওয়ার পর নাসির উদ্দীন বলেছেন, মানুষ যাতে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।
পাঁচজনের নির্বাচন কমিশনে সিইসি নাসির উদ্দীনসহ তিনজনই সাবেক সচিব। একজন সাবেক বিচারক ও সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা একজন রয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার তাদের নিয়োগের ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতন হয় ৫ আগস্ট। এর এক মাস পর ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। দেড় মাস ধরে শূন্য থাকার পর এখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো।
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তহমিদা আহ্মদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতন হয় ৫ আগস্ট। এর এক মাস পর ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। দেড় মাস ধরে শূন্য থাকার পর এখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো।
বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো দ্রুত নির্বাচন কমিশন গঠন করে ভোটের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়ে আসছিল।
নতুন কমিশন গঠনের পর গতকাল দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে দেশ নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করল।
এখন এই বার্তা গেল জনগণের কাছে। আমীর খসরু আরও বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন ভোটের জন্য যে প্রস্তুতি বা যে প্রক্রিয়া তার কতটুকু করতে পারেন, সেটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বিএনপি যে দুজনের নাম প্রস্তাব করেছিল, তার মধ্যে এ এম এম নাসির উদ্দীনের নাম ছিল। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি তাকে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিল। এখন তাকে করা হলো প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জোট গণতন্ত্র মঞ্চের দুটি দলের নেতারা নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে এই কমিশনের ওপর আস্থা রাখার কথা বলেছেন। তবে ওই জোটের আরেক নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি জানান, নতুন নির্বাচন কমিশনে প্রত্যাশিত কেউ নেই। তাই কমিশন নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, নতুন কমিশন অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে আস্থার প্রমাণ দেবে, সেটা জামায়াতের প্রত্যাশা।
এ ছাড়া ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান জানান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ছাড়া অন্যদের সম্পর্কে ধারণা নেই। তিনি বলেন, ‘সিইসি যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন, তাহলে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি জনগণের যে অনাগ্রহ এবং অনাস্থা তৈরি হয়েছে, সেটি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবেন বলে আশা করি।’
ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গণ অধিকার পরিষদের (একাংশ) সভাপতি নুরুল হক। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই অনেক ভেবেচিন্তে এই কমিশন করেছে। আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে চাই, আমরা তাদের স্বাগত জানাই।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দীনের বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। ১৯৫৩ সালের ১ জুলাই তার জন্ম। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করার পর শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। দুই বছর পর ১৯৭৯ সালে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন তিনি।
নাসির উদ্দীন জানান, দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। এরপর পরিকল্পনা বিভাগের সদস্য হয়েছিলেন। তিনি বিদ্যুৎ-জ্বালানি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ২০১০ সালের জুলাই মাসে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি।
এ ছাড়া নতুন নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক এবং ২০১৬ সালে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদমর্যাদায় বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও ছিলেন। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
আবদুর রহমানেল মাসুদ জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সময়। ওই পদ থেকেই তিনি অবসর নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে।
সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহ্মদ বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১৮ সালে। ওই বছরই তিনি প্রথমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং পরে পাট অধিদপ্তরের পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। ১৮তম বিএমএ লং কোর্সের এই সেনা কর্মকর্তা ৩৫ বছর মিলিটারি সার্ভিসে ছিলেন।
নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এই আন্দোলনের মূল বিষয়ই ছিল ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা সম্ভব নয়। সে জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাব।
নির্বাচন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ৭১ বছর বয়সী নতুন সিইসি আরো বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এই আন্দোলনের মূল বিষয়ই ছিল ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়। সে জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাব।’
নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে নানা রকম আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দীন বলেন, এ নিয়ে আগাম কিছু বলা যাবে না। কারণ, বিভিন্ন দল নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। ফলে সময় হলে বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে।
অনুসন্ধান কমিটির প্রস্তাবিত তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজনকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন। এখন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নেবেন সিইসিসহ কমিশনাররা।
নতুন কমিশন গঠিত হলো যেভাবে
অন্তর্বর্তী সরকার আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিল ৩১ অক্টোবর। ২০২২ সালে প্রণীত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের আওতায় ওই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়।
এই অনুসন্ধান কমিটির কাছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল ও পেশাজীবী সংগঠনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়েও আগ্রহী ব্যক্তিরা নাম প্রস্তাব করেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টির কাছ থেকে নাম চায়নি অনুসন্ধান কমিটি।
বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের ও সংগঠনের প্রস্তাব থেকে অনুসন্ধান কমিটি গত বুধবার রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করেছিল।
অনুসন্ধান কমিটির প্রস্তাবিত তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজনকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন। এখন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নেবেন সিইসিসহ কমিশনাররা।
এআর