ঢাকা : এ সময়ে রাষ্ট্রের কিছু সংস্কার করতে না পারলে আর কখনোই করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০৭ সালে একবার চেষ্টা করেছিলাম, কিছু কিছু করেছিলাম সেগুলো থাকেনি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে। এখন যদি না করতে পারি, সংবিধানের দোহাই দিই, অন্যান্য আইনের দোহাই দিই, তাহলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি অন্যায় হবে। বলছি না যে আমরা চার-পাঁচ বছর থাকব। এক বছরের মধ্যে সংস্কার করা সম্ভব।’
ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে দুই দিনের জাতীয় সংলাপের দ্বিতীয় দিন শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) ‘সংস্কারের দায় ও নির্বাচনের পথরেখা’ শীর্ষক অধিবেশনে এ কথা বলেন উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন।
রাজধানী ফার্মগেটের খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ এই সংলাপের আয়োজন করেছে।
তরুণদের রাজনৈতিক দল গঠনে উৎসাহিত করা উচিত মন্তব্য করে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘তাদের নিরুৎসাহিত করা ঠিক নয়। আমরা মনে করি নতুন রক্ত প্রয়োজন। তাদের নিরুৎসাহিত করবেন না। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ তাদের উৎসাহিত করুন। তারা আপনাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। তাদের যদি উৎসাহিত না করেন, তাহলে আমরা এ জিনিসই (আওয়ামী লীগের পতন) দেখব। আজ না হয় ১০ কিংবা ১৫ বছর পরে আবারও দেখব।’
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়ে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ধৈর্য ধরতে হবে। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নির্বাচন আইন পরিবর্তন করলে হবে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পদ্ধতির পরিবর্তন করলেই নির্বাচনী আইনও পরিবর্তন হয়ে যাবে। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বলেছিলাম, এবার যারা নির্বাচনে যাবে আম-ছালা দুটোই যাবে। সেটাই হয়েছে।’
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা দেশের স্থিতিশীলতা চাই। আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। আপনারা, তাঁরাও (ভবিষ্যৎ ক্ষমতাসীনেরা) বড় চ্যালেঞ্জে পড়বেন।’
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ‘সামনে আমাদের জন্য বড়, অনেক বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এটা শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসবে দেশের বাইরে থেকে। আমাদের নতুন প্রতিবেশী তৈরি হচ্ছে। সেটা স্বাভাবিক নয়, ভিন্নধর্মী প্রতিবেশী। আরাকান এখন নতুন বাস্তবতা। আমরা এত দিন বিবেচনা করতে পারিনি। এখন বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।’
দেশে নির্বাচনী আইনে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।
রাজনৈতিক দলগুলোর আয় নিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এখনকার রাজনৈতিক দলগুলো মিস্টার আলম-টালমের মতো লোকের পয়সা দিয়ে চলছে। এখনো রাস্তায় বলা হচ্ছে, আমরা ১৬-১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলাম না, নির্বাচন করতে পয়সা লাগবে, সেটার জন্য চাঁদাবাজি করছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। এই জায়গায় একটা বড় সংস্কার প্রয়োজন। আমরা দেখছি, একটা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থেকে বহিষ্কার করছেন, কিন্তু এটা এনাফ (পর্যাপ্ত) নয়।’
ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি করতে গেলে সেটার পরিণতি কী, সেটা দেখতে হবে। ছাত্রদের রাজনীতি অবশ্যই করা উচিত। তবে সেটা অবশ্যই ছাত্র সংসদের মাধ্যমে হওয়া উচিত। ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শেষ পর্যন্ত লীগ হতে হতে বাচ্চা লীগও হয়ে গেছে। সেটার পরিণতি কী, সেটা দেশ দেখছে।’
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ দরকার : বাংলাদেশে অবশ্যই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা হতে হবে বলে মনে করেন এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, সেই জায়গায় বিভিন্ন রকমের মানুষ আসবে। তারা একটা নির্বাচনের জন্য নীতিমালা তৈরি করতে পারে। তখন আলাদা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে না।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল পরিচালনার জন্য আইন থাকা প্রয়োজন বলেও মনে করেন সাখাওয়াত হোসেন। তিনি এই বিষয়ে বলেন, ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান আইন করেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলো মানেনি। একটা আইন অবশ্যই প্রয়োজন। না হলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর যে করণীয়, তা দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দল তৈরি হয়, কোন্দল তৈরি হয় এবং এক দল আরেক দলকে খেয়ে ফেলে।
পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই : সংলাপে সবার শেষে বক্তৃতা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
তিনি বলেন, ‘আমি জীবনভর অনেক আন্দোলন–সংগ্রামে অংশ নিয়েছি, বিজয়ী হয়েও বারবার হেরে গেছি। অনেক বিজয় এসেছিল, ধরে রাখতে পারিনি।’
তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন উঠেছে, দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন; নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, গুম হয়েছেন কিংবা যাঁরা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ ধরে রাখতে পারব তো?
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা সব সময়ই বলি, ভালো চাই, আরও ভালো চাই। আমাদের পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। কিন্তু মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সুযোগ করে দিয়েছেন গণ-অভ্যুত্থানের বিজয় ধরে রাখার। কিন্তু চাই চাই করে গেলে সব হারাব আমরা, আমরা আক্ষেপ করব। বিজয় ধরে রাখতে তাই সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের লক্ষ্যে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে সংলাপে অনেকে মন্তব্য করেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিক নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, ঐক্যে ফাটল ধরার কথাটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে নানা বিষয়ে। এটি গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্যই দরকার।’
প্রশাসনের কর্মকর্তারা নানা দাবিদাওয়া নিয়ে সারা দেশে ‘হুলুস্থুল’ পরিস্থিতি তৈরি করেছেন উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, এখন অভিযোগের সময় নয়। এখন সময় সহযোগিতা করার। কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন একা সব করে ফেলতে পারবে না। পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে।
গণফোরামের কো-চেয়ারম্যান সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংস্কারের ক্যানভাস বড় করে বড় বিপদ ডেকে আনা হবে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা অক্টোবরের মধ্যে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করবে, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেবে। তাহলে নির্বাচন আর দেরি করবেন কেন? নির্বাচন যত ঝুলিয়ে দেবেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ আরও বেশি দৃশ্যমান হবে।
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে এখন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। তিন ধরনের সংস্কৃতিতে গড়ে উঠেছে এই প্রজন্ম, এভাবে চলতে থাকলে তারা তো প্রথমে রাজনৈতিকভাবে, পরে হয়তো একদিন সশস্ত্রভাবে সংগঠিত হবে। তারা এভাবে তারা একটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে। তাই এক ভাষায় একমুখী উচ্চশিক্ষা–ব্যবস্থা প্রণয়নের দিকে যেতে হবে।
দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ঘোচাতে আইনি ও সামাজিক কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন নূরুল কবীর।
সংলাপের এই অধিবেশনে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সালেহ উদ্দিন।
এমটিআই