• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩০
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন

দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় মাল্টার নাগরিকত্ব চেয়েও পাননি তারিক সিদ্দিকের স্ত্রী-কন্যা


নিউজ ডেস্ক জানুয়ারি ১০, ২০২৫, ০৮:১১ পিএম
দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় মাল্টার নাগরিকত্ব চেয়েও পাননি তারিক সিদ্দিকের স্ত্রী-কন্যা

ঢাকা : ইউরোপের দেশ মাল্টার নাগরিকত্ব চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন শেখ হাসিনার সাবেক নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের স্ত্রী শাহীন সিদ্দিক।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহীন সিদ্দিক দুইবার আবেদন করেও মাল্টার নাগরিকত্ব পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত এমপি ও সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের চাচি।

অর্থপাচার, দুর্নীতি, প্রতারণা ও ঘুষের অভিযোগ থাকায় শাহীন সিদ্দিকের নাগরিকত্বের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে মাল্টার একটি অভিবাসন সংস্থা।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে মাল্টার নাগরিকত্ব–বিনিয়োগ প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে থাকা হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স নামে একটি সংস্থা শাহীন সিদ্দিকের আবেদন ফিরিয়ে দেয়। এই সংস্থাটি সেসময় বিদেশি নাগরিকদের মাল্টার নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে কাজ করত।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এ সংক্রান্ত নথিপত্র জোগাড় করছে। নথির তথ্য অনুযায়ী, শাহীন সিদ্দিক ঢাকায় ‘প্রচ্ছায়া’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘অবৈধভাবে সরকারি জমি দখলের’ অভিযোগ ছিল।

শাহীন সিদ্দিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা তারেক আহমেদ সিদ্দিকের স্ত্রী। তারেক আহমেদ সিদ্দিক ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত অক্টোবরে তারেক ও তাঁর স্ত্রী শাহীনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে।

শাহীন সিদ্দিক ২০১৩ ও ২০১৫ সালে মাল্টার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি তাঁর মেয়ে বুশরা সিদ্দিকের জন্যও আবেদন করেন। বুশরা সিদ্দিক টিউলিপ সিদ্দিকের আপন চাচাতো বোন। দ্বিতীয়বার আবেদনে তাঁকে ইংল্যান্ডের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তিনি লন্ডনে স্টুডেন্ট ভিসায় পড়াশোনা করছিলেন। বুশরা ‘প্রচ্ছায়া’–এর পরিচালক হিসেবেও কাজ করতেন।

শাহীনের করা প্রথম নাগরিকত্ব আবেদন ২০১৩ সালে সরাসরি বাতিল হয়ে যায়। কারণ ওই সময় গণমাধ্যমে প্রচ্ছায়ার বিরুদ্ধে ‘মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি, প্রতারণা ও ঘুষ’ সংক্রান্ত অভিযোগের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

২০১২ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ নামের সংস্থার নামে শাহীন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ঢাকায় মূল্যবান জমি দখলের অভিযোগ ওঠে। ২০১৬ সালে তিনি এসব জমি বিক্রি করে দেন। অভিযোগ আছে, তিনি তাঁর স্বামী তারিক সিদ্দিকের ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব জমি দখল করেন এবং সুযোগ বুঝে বিক্রি করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।

আবেদন বাতিলের বিষয়ে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স বলে, শাহীন সিদ্দিকের নেতৃত্বাধীন প্রচ্ছায়া নামক একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকায় মূল্যবান জমি দখল করে।

২০১৫ সালের আবেদনে শাহীন আর প্রচ্ছায়ার কথা উল্লেখ করেননি। পরিবর্তে নিজেকে ‘দ্য আর্ট প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড’–এর মালিক বলে উল্লেখ করেন। এরপর হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের একজন কর্মচারী এক ই–মেইলে জানান, মাল্টা কর্তৃপক্ষ এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আরও তথ্য চাচ্ছে।

২০১৫ সালের মার্চে শাহীন সিদ্দিক নিজের ও মেয়ের জন্য মাল্টার নাগরিকত্বের আবেদন করেন। এই যৌথ আবেদনের নথি অনুযায়ী, শাহীন সিদ্দিকের মাল্টার নাগরিকত্বের আবেদনের খরচ ছিল ৬ লাখ ৫০ হাজার ইউরো এবং তাঁর মেয়ের জন্য ২৫ হাজার ইউরো। পাশাপাশি, হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সকে ৭০ হাজার পাউন্ড ফি দিতে হতো।

এ সময় শাহীন সিদ্দিক তাঁর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের একটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য জমা দেন। তাঁর ওই অ্যাকাউন্টে তখন ২৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার ছিল। যা আবেদনের মাত্র দুই মাস আগে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস সম্পর্কে নথিতে কোনো কিছু উল্লেখ ছিল না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের মুদ্রা বিধি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি তাঁর ব্যাংক হিসাব থেকে বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারেন না।’

২০১৫ সালে দ্বিতীয় আবেদনের নথিতে পাওয়া যায়, শাহীন সিদ্দিক নিজেকে ‘দ্য আর্ট প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক উল্লেখ করেছেন। এরপর ওই বছরের শেষের দিকে প্রকাশিত এক নথিতে দেখা যায়, শাহীন সিদ্দিকের দ্বিতীয় আবেদনও বাতিল করা হয়েছে।

মাল্টা সরকারের একটি গেজেটে নিশ্চিত করা হয়, শাহীন সিদ্দিক ও তাঁর মেয়ে বুশরা কেউই নাগরিকত্ব পাননি।

বুশরা সিদ্দিক যখন লন্ডনে পড়াশোনা করছিলেন তখন সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনের ওপরে গ্র্যান্ড গথিক বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। এই ফ্ল্যাটটি তাঁর জ্যাঠাতো বোন টিউলিপের কিংস ক্রস ফ্ল্যাটের পাশেই।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, টিউলিপকে ফ্ল্যাটটি উপহার দিয়েছিলেন আবদুল মুতালিফ নামে এক প্রোমোটর। তাঁর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।

বুশরা পড়াশোনা শেষ করে লন্ডনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং পরে আমেরিকান বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগানে চাকরি নেন। ২০১৮ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘লাইফস্টাইল, ফ্যাশন ও ট্রাভেল’ ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে কাজ শুরু করেন।

২০১৮ সালে বুশরা সিদ্দিক একটি ইউটিউব সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি ব্যাংকের চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ একটা সময় ‘যুদ্ধ’ করে যাচ্ছিলেন। এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ আমেরিকান ব্যাংকে মেয়ে চাকরি করে— এ নিয়ে বাবা গর্বিত ছিলেন। কিন্তু এরপরও তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেন।

২০১৮ সালে বুশরা স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে নর্থ লন্ডনে গোল্ডার্স গ্রিনে ১৯ লাখ পাউন্ডে পাঁচ বেডরুমের একটি বাড়ি কিনেছিলেন। জমি রেজিস্ট্রির নথি থেকে জানা যায়, এই বাড়ির ওপর কোনো বন্ধকি ঋণও (মর্টগেজ) নেই। বাড়ি কেনার অর্থের জোগান বিষয়ে ইউটিউবে বুশরা বলেন, ‘আমার কিছু সঞ্চয় ছিল।’

মাল্টার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে বুশরা সিদ্দিক এবং শাহীন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। তবে তাঁরা সাড়া দেননি।

বুশরার বাবা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!