ঢাকা : যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন শেষ হয়েছে ৩ নভেম্বর ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে। সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে ২৯০টি করায়ত্ত করেই বাজিমাত করেন বাইডেন। অপরদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২১৪টি ভোট। দুটি অঙ্গরাজ্যের ফলাফল আসার আগেই জো বাইডেনের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে যায়।
নির্বাচনের সবকিছুই গতানুগতিক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান মোতাবেক হয়েছে। এমনিতেই এ দেশটির নির্বাচনে ফল কারচুপির সুযোগ মোটেই নেই; তদুপরি বিশ্ব মিডিয়ার সতর্ক দৃষ্টির সামনে তা ছিল অসম্ভব ব্যাপর। তা সত্ত্বেও পরাজিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী ফলাফল না মানার পূর্ব ঘোষণায় এখনো অটল আছেন। পুনঃভোট গণনাসহ বিভিন্ন অভিযোগে তিনি আইনি লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ত্যাগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে সে আইনি লড়াইয়ে তিনি কতটা কামিয়াব হবেন তা নিশ্চিত নয়। বরং পশ্চিমা মিডিয়াগুলো ইতোমেধ্যে জানিয়েছে, ট্রাম্পের সব চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে এবং ২০ জানুয়ারির পর তিনি আর হোয়াইট হাউসে থাকতে পারবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন ছিল বিশ্বব্যাপী উৎসুকের বিষয়। বিশ্ব মোড়ল হিসেবে পরিচিত দেশটির স্টিয়ারিংয়ে কে বসছেন, তা নিয়ে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। আমরা এখানে নির্বাচনের কিছু খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলতে চাই।
ব্যালটের রকম : অবশ্যই ভোটের সাথে ব্যালট জড়িত। এবারের নির্বাচনে ভোটাররা বিভিন্নভাবে ভোট প্রদান করেছে। ভোটারদের একটা অংশ, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ডেমোক্র্যাটদের বড় অংশ ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। তারা ব্যালট পেপারের জন্য আবেদন করেছেন প্রথমে। তারপর ভোট দিয়ে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন দিনের বেশ আগে থেকেই অগ্রবর্তী ভোট নেওয়া শুরু হয়। নির্বাচনের দিন লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকে ভোট দিয়েছেন, যাদের অধিকাংশই রিপাবলিকান। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের এরকমই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বিদেশে অবস্থানরত আমেরিকান এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ভোট দিয়েছেন। সেগুলো ডাকযোগে এসেছে এবং গণনায় যুক্ত হয়েছে। ভোটের দিন কারো কারো আইডি না থাকা, ভুল ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কারণে সরাসরি ভোট দিতে পারেননি। এদের শর্তাধীন ভোট দিয়েছেন যাদের প্রভিশনাল ব্যালট বলা হচ্ছে। এই ব্যালটগুলো আলাদা করা হয়েছে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গণনা করা হয়। পুরো বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ছিল, যে কারণে ফল প্রকাশে বিলম্ব হয়েছে, এর বাইরে কিছু নয়। এসব আগেও ছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতা এত হাড্ডাহাড্ডি না হওয়ায় এসব ব্যালট নিয়ে ইতঃপূর্বে কোনো কথা হয়নি।
ভোট গণনায় ব্যালটের প্রভাব : ভোটগ্রহণ শেষ হবার সাথে সাথে গণনা শুরু হয়। আমেরিকায় তিনটি সময়-অঞ্চল থাকার কারণে নিউইয়র্কে যখন ভোট শেষ হয়, লসঅ্যাঞ্জেলেসে তখনো ভোটগ্রহণ চলতে থাকে। তা ছাড়া ভোটগ্রহণের সময়সীমা পুরো দেশে একরকম নয়। আশ্চর্য হচ্ছে, ঐতিহ্যগতভাবে নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাষ্ট্রের দুটি কেন্দ্রে ভোটের আগের দিন রাত বারোটার পর ভোটগ্রহণ করা হয় এবং সাথে সাথে ফলাফল ঘোষণা করে দেওয়া হয়। অবশ্য এদের ভোটার সংখ্যা অতি নগণ্য। যেমন একটি কেন্দ্রে মাত্র ৫ জন, আরেক কেন্দ্রে ২৬ জন ভোটার ছিলেন। তবে জাতীয়ভাবে কেন্টাকি অঙ্গরাষ্ট্রের একটি কেন্দ্রে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছটায় সর্বপ্রথম ভোটগ্রহণ সময়সীমা শেষ হয়।
এরপর ভোট গণনা শুরু হয়। বিভিন্ন অঙ্গরাষ্ট্রে ভিন্ন ভিন্ন আইনের কারণে ভোট গণনাও ভিন্ন রকম। যেমন পেনসিলভেনিয়ায় ডাকযোগে আসা ব্যালট সবশেষে গণনা করা হয়। অন্যদিকে কেন্টাকিতে ডাকযোগে আসা ব্যালট আগে গণনা করা যায়। তাই গণনার সময় দেখা গেছে কেন্টাকি বা ওহাইও কিংবা ফ্লোরিডাতে গণনার শুরুতে জো বাইডেন বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু অল্প সময় পরেই ট্রাম্প তাকে ছাড়িয়ে গেছেন। এই ধারায় তিনি উইসকনসিন, মিশিগান, পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া অঙ্গরাষ্ট্রে বিপুল ভোটে এগিয়েছিলেন। যার ধারাবাহিকতায় নির্বাচনের দিন রাত দুটোয় অতি আনন্দে বোকার মতো নিজেকে জয়ী বলে ঘোষণাও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তখনো বিপুল পরিমাণ ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনা বাকি ছিল। সেসব ব্যালটই পরে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
তা ছাড়া কোনো কোনো অঙ্গরাষ্ট্রে নিয়ম হলো, দুই প্রার্থীর ভোটের পার্থক্য এক শতাংশেরও অর্ধেক হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃগণনা শুরু হয়। কোনো কোনো জায়গায় ২০০০ ভোটের কম ব্যবধান হলে, আবার কোনো কোনো জায়গায় এক শতাংশের দশভাগের একভাগ হলে স্বয়ংক্রিয় পুনঃগণনা হয়। তবে জর্জিয়ায় এক শতাংশের অর্ধেকের কম হলে পুনঃগণনার আবেদন করা যায়। ট্রাম্প তা করেছেন।
হোয়াইট হাউস ত্যাগ : তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়লেন না। তখন কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু লেখা নেই। নির্বাচনে হেরে কেউ হোয়াইট হাউস ছাড়বেন না এটা সংবিধান রচয়িতারা হয়তো চিন্তা করেননি। কিন্তু ট্রাম্প-কর্মকাণ্ড হচ্ছে চিন্তারও বাইরে। সে ক্ষেত্রে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। দেশের সেনাবাহিনীসহ সকল সিক্রেট সার্ভিস তার অধীনে চলে যাবে। তারা হোয়াইট হাউস থেকে অবাঞ্ছিত বা অবৈধ অধিবাসীকে বের করে দেবেন। ট্রাম্প যদি হোয়াইট হাউস ত্যাগ না করার প্রত্যয়ে অনড় থাকেন, তাহলে তার জন্য অতি দুর্ভাগ্যের বিষয় হবে, খুব শিগগিরই তিনি হোয়াইট হাউসে অনধিকার প্রবেশকারী হয়ে যাবেন। এতে হোয়াইট হাউস ভারমুক্ত হবে সন্দেহ নেই। কারণ এই ঐতিহাসিক ভবনে বসে ট্রাম্প অসংখ্য মিথ্যে বলেছেন, অকথ্য গালিগালাজ করেছেন। বহু মানুষকে অপমান-হেনস্তা করেছেন। হোয়াইট হাউসের ইতিহাসে তা অবশ্যই কলঙ্কময় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ট্রাম্পের আইনি পদক্ষেপ : ক্ষমতার সুখের দিকের সাথে দুঃখের দিকও আছে। ক্ষমতা চিরদিন সংরক্ষিত নয়। আকবর-আওরঙ্গজেবদের জগৎ এখন অতীত। স্বভাবতই ট্রাম্প ক্ষমতা ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না। তিনি হেরে গেছেন। কিন্তু মানতে কষ্ট হচ্ছে। তাই ভিত্তিহীন সব অভিযোগ করছেন। সর্বোচ্চ আদালতে সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল বিচারপতি থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অযথা বাগাড়ম্বর করছেন। তিনি জানেন এতে কিছুই হবে না। তবুও করছেন, কারণ তার মূল উদ্দেশ্য বিপুল সমর্থকগোষ্ঠীকে উজ্জীবিত করে অসাংবিধানিক কিছু করা যায় কি না। তবে সত্য হচ্ছে, আমেরিকার ২৪৪ বছরের গণতন্ত্র এত ঠুনকো নয়। সামান্য ঝড়ে তা টলতে পারে না।
আইনি প্রক্রিয়া সব সময়ই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। সেইসাথে ব্যয়বহুলও। ট্রাম্প তার আইনি প্রক্রিয়ায় অনুদানের জন্য ভিক্ষা শুরু করেছেন। তাকে অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য এবং শক্ত প্রমাণ দাখিল করতে হবে। স্থানীয় আদালত রায় দেবে, তা সুপ্রিম কোর্টে যাবে। সুপ্রিম কোর্ট প্রমাণের গুরুত্ব বিবেচনা করে রায় দেবেন। ফালতু অভিযোগে কাজ হবে না। ডাকযোগে আসা ভোট, ভোটকেন্দ্রে পর্যবেক্ষকদের ঢুকতে বাধা, অবৈধ ভোটার সংক্রান্ত অভিযোগকে বালসুলভ মনে করছেন পর্যবেক্ষকগণ। এসব অভিযোগ তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখা গেলেও আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একেবারেই অচিন্তনীয়।
ব্যালট পুনঃগণনা : জর্জিয়াসহ কোনো কোনো অঙ্গরাষ্ট্রে ট্রাম্প ভোট পুনঃগণনার আবেদন করেছেন। অধিকার বলে এই আবেদন তিনি করতেই পারেন। বিপুল অর্থ ব্যয়ে পুনঃগণনা হবে। এতে তার মানসিক শান্তি হবে শুধু, কাজের কাজ কিছুই হবে না। পুনঃগণনার ফলাফল তার পক্ষে যাবে না সেটা অবধারিত । ভোট পুনঃগণনা একটি অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া গণতন্ত্রে। অতীতে বহুবার এই কাজটি হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত পুনঃগণনাটি ফ্লোরিডাতে হয়েছে ২০০০ সালে। বুশ এবং আল গোরের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই সুতোর ওপরে ঝুলে ছিল। টানটান উত্তেজনা, কে জিতবে কে হারবে দোলাচল। সবশেষে বুশ মাত্র ৩২৭ ভোটে জিতেছিলেন। ফলাফল পরিবর্তিত হয়নি। প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে পুনঃগণনায় ফলাফল পরিবর্তনের কোনো ইতিহাস নেই। ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল সময়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবরকম নির্বাচনে সাড়ে চার হাজারেরও বেশিবার ভোট পুনঃগণনা হয়েছে। মাত্র তিনটি ক্ষেত্রে ফলাফল উল্টে গেছে। অবশ্য তাও হয়েছে স্থানীয় বা কংগ্রেসের নির্বাচনে। তাই পুনঃগণনায় গণেশ উল্টে ট্রাম্পের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ে দেবে, এমন কোনো সম্ভাবনাই নেই।
লেখক : কানাডায় জিওটেকনিকাল বিভাগে কর্মরত বাংলাদেশি
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।