ঢাকা : একাত্তরে বাংলাদেশের ভেতরে ও বহির্বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ও আলোড়িত ব্যক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যান চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। তার আহূত অসহযোগ আন্দোলন আর অসহযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, সে আন্দোলন রূপ নেয় বিশাল গণবিদ্রোহে। সেই বিদ্রোহকালীন অবস্থায়ও জনগণকে শান্ত রাখা এবং সামনে চলার কাজটি সুচারুভাবে করেছেন তিনি। দেশবাসী তো বটেই বিদেশি রাষ্ট্রনেতা, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন একজন ব্যক্তি প্রশাসন, পুলিশ ও মিলিটারি ছাড়াই সমগ্র জনগোষ্ঠীকে পরিচালিত করছেন। তার প্রতিটি আদেশ নির্দেশ জনগণ সানন্দে মেনে নিচ্ছে, তার কথায় লাখ লাখ তরুণ জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।
সে সময় শেখ মুজিব ছিলেন বিস্ময়। বিদেশি সাংবাদিক যারাই পেশাগত দায়িত্ব পালনে ঢাকায় এসেছিলেন তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন বঙ্গভবন নয়, সচিবালয় নয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দোতলা-বাড়িটি থেকে শেখ মুজিব দেশ পরিচালনা করছেন। মহল্লার অপরিচিত কোনো রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে হাইকোর্টের বিচারকরা পর্যন্ত সেখানে এসে তার পরামর্শ নিচ্ছেন।’
সে সময় একটি কথা বেশ প্রচলিত হয়েছিল All roads lead to 32. এমনকি পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও মার্চের বাংলাদেশ দেখে বুঝে নিয়েছিলেন বাঙালিকে আর পদানত রাখা যাবে না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনিবার্য। তারপরও বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী কামান ও ট্যাংকের তলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। সেটি ছিল আহম্মকি। একটা দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী যখন শাসকদের বিরুদ্ধে যায় তখন তাকে দমিয়ে রাখা যায় না। পাকিস্তানি মারণাস্ত্র হয়তো বিজয়কে কিছুটা বিলম্বিত করছে, লাখো লাখো জীবন কেড়ে নিয়েছে সত্য। কিন্তু তার জন্য পাকিস্তানকেও কম খেসারত দিতে হয়নি।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদ যথার্থই বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।’
পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেখ মুজিবকে তাঁর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তী ৯ মাস তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকস্তানে কারারুদ্ধ। কিন্তু সেই কারারুদ্ধ শেখ মুজিব অনেক বেশি ভীতি ও শঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের কাছে। ২৬ মার্চ বেতার টিভিতে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন। নিষিদ্ধ করেন তার দল আওয়ামী লীগকে। তার এই দম্ভ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে যে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় তা বিদেশি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর বিশ্ব সম্প্রদায় পাকিস্তান ও তার শাসকদের ধিক্কার দিতে থাকে। তাদের একটাই প্রশ্ন জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কেন পার্লামেন্টে বসতে দেওয়া হলো না? কেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসল না? কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে কারাগারে পাঠানো হলো? এসব প্রশ্নের জবাব পাকিস্তানিদের জানা ছিল না। তাই জাতিসংঘে, বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার কাছে পাঠানো তাদের ব্যাখ্যা ছিল আজব কল্পকাহিনী ও মিথ্যাচারে ভরা।
সে সময় বিশ্বজনমত, রাষ্ট্রনেতা তথা গণমাধ্যমসমূহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কি চোখে দেখেছে, রাষ্ট্রনেতা হিসেবে কীভাবে শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করেছে এ পর্বে তার কিছু বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করব। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত অভিযান ও গণহত্যার প্রতিবাদ করে ৩১ মার্চ ভারতীয় লোকসভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয় :
‘পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে লোকসভা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে। পূর্ববাংলার সমগ্র জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সেখানে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ন্যায়সঙ্গতভাবে যে রায় দিয়েছে, সেই রায়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের বদলে পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান সরকার কেবল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়নি তারা পূর্ব বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে বেয়নেট, মেশিনগান, ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে। এই লোকসভা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ করছে এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি অবিলম্বে নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে।’
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার দেশের সমর্থন কামনা করেন। এই বৈঠকেই ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর তাজউদ্দীন আহমদকে জানান।
স্বভাবত ভারতের প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা প্রস্তাবকে পাকিস্তান সরকার গ্রাহ্যে আনেনি। তারা বরাবরই ভারতকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু এপ্রিলের ২ তারিখে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাস পদগোর্নি যখন পূর্ববাংলার গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে ইয়াহিয়ার কাছে কড়া ভাষায় চিঠি লেখেন তখন পাকিস্তানের কিছুটা টনক নড়ে। সে সময় দুই সুপার পাওয়ারের একটি সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের সঙ্গে পাকিস্তানের অনেক যৌথ প্রকল্প ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপের মধ্যে রাখার জন্য ইসলামাবাদ মস্কোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলত।
ইয়াহিয়া খানকে লেখা পদগোর্নির চিঠিতে বলা হয় : ‘ঢাকার আলোচনা ভেঙে যাওয়ার খবর এবং সামরিক প্রশাসন চূড়ান্ত ব্যবস্থা অবলম্বন প্রয়োজন মনে করে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে সামরিক বলপ্রয়োগ করেছেন- এ খবর সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীর উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে।... অগণিত মানুষের প্রাণহানি, নিপীড়ন ও দুঃখকষ্টের খবরে সোভিয়েত জনগণ বিচলিত না হয়ে পারে না। মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনীতিককে বন্দি করায় নির্যাতন করায়ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ বোধ করছে। পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সেখানকার মানুষের ওপর নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য এবং সমস্যা সমাধানের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায় উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি ব্যবস্থা করার জন্য আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।’
২.
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। বিশেষ করে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন ও তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন জবর দখলকারী পাকিস্তান শাসকদের সমর্থক। কিন্তু এডওয়ার্ড কেনেডিসহ বহু ডেমোক্রেট-রিপাবলিকান সিনেটর ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। সহযোগিতা করেছে সে দেশের সংবাদপত্র ও সাধারণ মানুষ।
একাত্তরে ঢাকায় মার্কিন কনসুলেট জেনারেল ছিলেন আর্থার কে বাড। তিনি সে সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন পররাষ্ট্র দপ্তরে তাতে স্পষ্টত বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের প্রতি জোরালো সমর্থন ছিল। রিপোর্টের একাংশে বলা হয় :
‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এখন অপরিহার্য। অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতরে অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছিল, পূর্ব পাকিস্তানি জনসাধারণের ওপর সামগ্রিক লাঞ্ছনার জন্য শিগগিরই তা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হবে—বাংলাদেশ এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এখানকার বর্তমান সংঘর্ষের পেছনে অর্থনৈতিক ও রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতি ভাষা ও সামাজিক চালিকাশক্তিগুলোর প্রশ্ন নিবিড়ভাবে জড়িত রয়েছে।
শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের নীতিমালা গত নির্বাচনে জনগণের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে সমর্থিত হয়েছে। এই ঘটনা অর্থনৈতিক নীতির ওপর প্রদেশের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তান্তরিত ক্ষমতার সংশোধনকেই জোরদার করেছে—যার প্রতিক্রিয়ায় ইয়াহিয়া সরকার একটি আতংকের রাজত্ব স্থাপন করতে যাচ্ছে, এতে পুরো চেহারা ধীরে ধীরে সবার কাছেই উন্মোচিত হবে।’
এই রিপোর্টের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করা। আর্থার কে বাড তার রিপোর্টে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর ব্যাপারে ভুল পদক্ষেপ নিলে এ অঞ্চলে সোভিয়েত ও চীনা প্রভাব আরো জোরদার হবে। রিপোর্টটি লেখা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে, তখনো চীনের নীতি পরিষ্কার ছিল না বলে আর্থার কে বাডের রিপোর্টে চীনের কথা রয়েছে। একাত্তরে চীনের নীতি মোটেই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না।
সে সময় পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ফারল্যান্ড। সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার সঙ্গেও তার দোস্তি ছিল। শুরুতে তিনিও শেখ মুজিবের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তার সে চেষ্টা সফল হয়নি। তবে ফারল্যান্ড দাবি করেন যে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে না ঝোলানোর ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানকে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া কি প্রভাবিত হয়েছিলেন? এ সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসন ফারল্যান্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন :
When history by book are written on the war, it will be shown that US Policy and our local efforts in Pakistan kept Mujib alive. After Mujib's arrest, I talked frequently with Yahya and often mentioned Mujib... I counselled Yahya not to kill this man. Yahya was not so convinced that he intended to spare Mubib forever. When Yahya left office in disgrace at the end of the war, he left behind the death warrant for Mujib. The date was blank. So his successors could till it in at their convience and blame the execution on Yahya. Yahyas's success wisely refused to use the document. (সূত্র : Jack Anderson Papers)
বিশ্ববিখ্যাত লেখক বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এমনকি তিনি একদল সহযোদ্ধা নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে যুদ্ধ করারও অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আন্দোলনে আঁদ্রে মালরোর বক্তব্যও ছিল দ্ব্যর্থহীন। এ ছাড়া রিচার্ড নিকসনকে এক চিঠিতে তিনি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সমর্থন না করার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন :
‘আপনার বিমানবাহী জাহাজ কলকাতাকে হুমকি দিতে সক্ষম হলেও যুক্তরাষ্ট্র ওইসব সমবেত মৃত্যুকামী জনগণের বিরুদ্ধে কখনোই যুদ্ধ করে পেরে উঠতে পারবে না। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আপনার সেনাবাহিনী যেখানে ভিয়েতনামে নগ্নপদ যোদ্ধাদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে কি আপনি বিশ্বাস করেন যে ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত একটি দেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইসলামাবাদের সেনাবাহিনী একটি দেশকে কোনোদিন দাবিয়ে রাখতে পারবে?’
প্রথম থেকেই পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ব্রিটিশ সরকার ও বিরোধী রাজনীতিকরা ছিলেন সন্দেহভাজন। কমনওয়েলথ এর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে তারা পাকিস্তান সংকটের রাজনৈতিক সমাধান আশা করেছিলেন। স্বভাবতই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল তাদের কাম্য। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছেন প্রভাবশালী ব্রিটিশ রাজনীতিকরা। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন কমন্স সভার সদস্য লর্ড পিটার শোর-এর বিবৃতিটি ছিল ভবিষ্যদ্বাণীর মতো।
পিটার শোর বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি পাকিস্তান ভেঙে গেছে। ভৌগোলিকতায় যেমন তারা এক হজার মাইল দূরত্বে ছিল তেমনি তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষার দিক থেকেও সেই দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। পূর্ব বাংলা থেকে প্রতিমাসে ১০ লাখেরও বেশি লোক পালিয়ে যাচ্ছে—সেখানে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার চাপ বা অন্য কোনো উপায়ে পাকিস্তানের দুই অংশকে একই রাজনৈতিক ছাতার মধ্যে রাখতে পারবে বলে সেরকম কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না।’
অস্ট্রেলিয়াও বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে নিশ্চুপ ছিল না। বিশেষ করে ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের পর বিভিন্ন ফোরামে ও দেশের জাতীয় সংসদে অস্ট্রেলিয়ান নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ২২ মে এপ্রিল সংসদ সদস্য ব্রায়ানটের প্রশ্নের জবাবে অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাক সোহান একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতির ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ :
‘প্রাণহানিতে অবশ্যই অমরা দুঃখ প্রকাশ করছি এবং আমি সংসদকে জানাতে পারি ঠিক কতটুকু আমরা দুঃখ প্রকাশ করতে পারি, বিশেষ করে আমরা উল্লেখ করছি যে, রক্তপাত ঘটেছে। কারণ সম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন হয়েছে। আমরা অবশ্যই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিবৃতিকে স্বাগত জানাই যে যত দ্রুত সম্ভব তিনি বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন। আমরা আশা করি আর কোনো প্রাণহানি ঘটবে না এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা হবে, ভদ্রভাবে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে।’
৩.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দূরপ্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের দেশগুলো নৈতিক ও মানবিক সমর্থন দিলেও নিশ্চুপ ছিল মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত ছাড়া এ অঞ্চলে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো। বার্মা ও শ্রীলঙ্কা পুরোপুরি পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিল। ভারত পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিলে শ্রীলঙ্কাই তাদের রাজধানীকে বিকল্প রুট হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেয়। এই পথে পাকিস্তান থেকে শুধু বেসামরিক যাত্রী ও মালামালই আসেনি, এসেছে সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র। ভুটানের পররাষ্ট্রনীতি ছিল অনেকটা ভারতের সমার্থক। নেপাল ও ভারতের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা ছিল। রাজা বীরেন্দ্র দেশের ভেতরে বা বাইরে যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই সন্দেহের চোখে দেখতেন। এ কারণে তার বশংবদ সরকার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু নেপালের জনগণ পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। তারই প্রতিধ্বনি পাই নেপালের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা বি বি কৈরালার বক্তব্যে। নয়াদিল্লিতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আজ আমরা সমবেত হয়েছি বাংলাদেশে সংঘটিত মহান ট্র্যাজেডির ছায়াতলে। নিরস্ত্র সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি সামরিক বাহিনী দ্বারা অপমানিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের একটা বীরোচিত দিকও রয়েছে- তারা পাকিস্তানের শক্তিমান সামরিক রাজত্বের মোকাবিলা করছে। বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে নেপালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছি। সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে যা-ই হোক, সমগ্র জনতা আন্তরিকভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন করছে।’
বিখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ জন কেনেথ গলব্রেথ এক সময় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি উপমহাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। একাত্তরে বাংলাদেশের ঘটনাবলি তাকেও উদ্বিগ্ন না করে পারেনি। পাকিস্তানিদের প্রতি কোনোরকম সাহায্য না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে তিনি লেখেন— 'It is to hope that the two great Islamic communities of the sub-continent can still find some relationship such as that between two parts of a commonwealth which will allow then to live in independent companionship. But there thrust be full autonomy and self government for East Bangal. Accordingly no action of ours should encourage or seem to encourage military domination of the east by west.'
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।