• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রস্তাবনা


এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম জানুয়ারি ১২, ২০২১, ০১:০২ পিএম
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রস্তাবনা

ঢাকা : ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার,/শেখ মুজিবুর রহমান!/দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/রক্তগঙ্গা বহমান/তবু নাই ভয়, হবে হবে জয়,/জয় মুজিবুর রহমান।’

বাংলা ভাষার শক্তিমান কবি অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের মহানায়ককে এমন আশীর্বাদের শব্দশৈলী ব্যবহার করে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন। মনে মনে, প্রাণে প্রাণে, চেতনায় বাঁচিয়ে রাখার এই অমোঘ বাণী বাঙালির প্রাণসত্তায় যতদিন অনুরণিত হবে, এ ভাষাভাষীর মানুষ যতদিন শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা করবে, ততদিন তাঁর কীর্তিতে বেঁচে থাকবেন সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে দেশি-বিদেশি অনেক সুনাম, সম্মান, খ্যাতি অর্জন করে নানাবিধ পুরস্কার ও উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। জুলিও কুরি উপাধি তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য আমরা এমন একজন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক, অসীম প্রাণশক্তিতে ভরা আত্মবিশ্বাসী বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ককে পেয়েছিলাম, গরিব-দুখী, মেহনতি মানুষের মুক্তির নিশানা হিসেবে। যার তুলনা তিনি নিজেই।

ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতা প্রদর্শন করেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। মা-মাটি-মানুষ কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। দম্ভ করে ঘোষণা করেছিল বাংলার মাটি চায়, মানুষ চায় না তারা। নিকৃষ্টতম বিকৃত লোলুপতা দেখিয়ে তারা পৃথিবীর যেকোনো নিন্দিত ইতিহাসকেও হার মানিয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের দায়িত্ব নিয়ে সেদিন স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত করে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে বাংলার মানুষকে প্রস্তুত না করলে বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের দায়িত্ব নিয়ে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের রাষ্ট্রপরিচালনায় যেসব দিকনির্দেশনা দিয়ে রাষ্ট্রকাঠামোকে দাঁড় করিয়েছিলেন তার নজির বিশ্বে খুবই বিরল। এত অল্প সময়ের মধ্যে পরিপূর্ণ একটি লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। ঈর্ষাকাতর আর পথভ্রষ্ট কিছু কুচক্রী মহলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও কিছু নিকট আত্মীয়স্বজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন দর্শন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সেই চেষ্টার সক্রিয় প্রভাব পরবর্তী সময়ে বেশকিছু সরকারকে নির্লজ্জভাবে বহন ও বিকশিত করতে দেখা গেছে।

’৭৫-পরবর্তী সময় থেকে এরশাদ সরকারের স্বৈরশাসন পর্যন্ত মূলত দেশটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হচ্ছিল না। ’৯০-র স্বৈরশাসন অবমুক্ত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা তার দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করে স্বৈরশাসনের অবসান করেন। বাংলার মানুষের ভাগ্যাকাশে নতুন করে গণতন্ত্রের স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের অরাজনৈতিক চর্চার রেশ এবং ষড়যন্ত্রকারীদের দৌরাত্ম্যের প্রকাশ ঘটে নির্বাচনে। তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে মাঠের রাজনীতি করে জনমানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করে ১৯৯৬ সালে তিনি এবং তার দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়।

যুগ যুগ ধরে চলে আসা পাহাড়ের বিশৃঙ্খলা পাহাড়ি ও বাঙালির জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এত দীর্ঘ সময়ের অশান্ত পরিস্থিতিকে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, কুচক্রীদের তৈরি কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাংলার মাটিতে বিচার করার সক্ষমতাসহ নেতৃত্বের নানাবিধ গুণ, সাহস ও শক্তিমত্তা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।

জন্মলগ্ন থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে অমীমাংসিত ছিটমহলের শান্তিপূর্ণ সমাধান করে কূটনৈতিক সফলতা, আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে অমীমাংসিত বিবদমান সমুদ্রসীমার চূড়ান্ত বিজয় আমাদের এক অনন্য অর্জন।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, অমূলক অভিযোগের প্রতিবাদ করে বিশ্বব্যাংক এবং দাতা দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ অর্থায়নে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কনস্ট্রাকশন কাজের সক্ষমতা প্রমাণ করে  স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ বড় চ্যালেঞ্জ।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানকেই শুধু পেছনে ফেলেননি বরং বিশ্বের উন্নত যে কয়টি দেশ তার চলমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে, তাদের সাথে তুলনা করলেও আমাদের প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রা অতুলনীয়।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সাং সুচি মানবতা লঙ্ঘন করে অমানবিক হয়ে উঠলে তার দেশের প্রায় এগারো লাখ মানুষ অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে, সারা বিশ্বমানবতা যখন হাত গুটিয়ে নিয়ে নিঃস্বতার পরিচয় দিয়েছে, ঠিক সে মুহূর্তে দেশের নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করেও এত বড় সংখ্যক বাস্তুহারা মানুষকে আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য দিয়ে মানবতারই জয়ধ্বনি উচ্চারিত করেছি আমরা।

বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা প্রদান করে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে যেসব বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং বিশ্বজনমতকে এ লক্ষ্য অর্জনে যতটুকু একত্র করতে পেরেছেন, তা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য করে তুলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনবদ্য ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করেছেন। বাঙালির মুক্তির ম্যাগনাকার্টা হিসেবে পরিচিত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, বাঙালির মুক্তি ও অন্যান্য গুরুত্ব বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সব সূচক আজ অগ্রগামী, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতুর সফল নির্মাণ, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, মেট্রোরেল নির্মাণ, আধুনিক নৌ জাহাজ নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, দেশে বিদ্যমান নদ-নদীগুলোর পুনঃসংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধনের চেষ্টা ও সেই সঙ্গে ৬৮ হাজার গ্রামবাংলায় শহুরে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনযাত্রায় নতুন করে আধুনিক মাত্রা সংযোজন প্রক্রিয়া, গৃহহীন কোনো মানুষ থাকবে না মর্মে গৃহদান কর্মসূচির বাস্তবায়ন, কোটি শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ, স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক নারীশিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন, বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম চালুকরণ, গরিব দুঃখী দুস্থ ও বয়স্কদের ভাতা প্রদান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপযুক্ত ভাতা প্রদান ইত্যাদি মানবিক কর্মসূচি গ্রহণ এবং ইতোমধ্যেই শতভাগ বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশকে উন্নয়নের যে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তা সময়, সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্যের বিবেচনায় সত্যিই বিস্ময়কর এবং বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় তা অনেক বেশি সন্তুষ্টিদায়ক ও সম্মানজনক।

বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্কলারদের নিয়ে একটি টিম গঠনের মধ্য দিয়ে অন্তত বছরব্যাপী গবেষণা করে ক্লাসিক বঙ্গবন্ধুকে এবং বঙ্গবন্ধু দর্শনের নন্দনতত্ত্বকে উপস্থাপন করে বিচার বিশ্লেষণ অন্তে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ প্রবর্তন করা আবশ্যক। যা আর্থিক মূল্য, সম্মান ও মর্যাদার বিচারে বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত সর্বোচ্চ সম্মানিত পুরস্কার এবং অধিক গুরুত্ব বহন করবে। বোধ করি বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে বিশ্বসেরা পুরস্কার দেয়ার যোগ্যতা আমাদের রয়েছে। জাতির পিতার শততম জন্মবার্ষিকীতে এমন একটি গবেষণালব্ধ পুরস্কারের প্রবর্তন করা গেলে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীতে সেটি হতে পারত সেরা নিবেদন। তহবিল সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বাঙালির উদার মন-মানসিকতাই যথেষ্ট বলে মনে করি। দেশ এবং দেশের বাইরে বঙ্গবন্ধুকে যারা হূদয়ে ধারণ করে, তাদের অনুদান গ্রহণযোগ্য হতে পারে। নৈতিক আদর্শে পরিচালিত কোনো দেশি-বিদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছায় প্রদত্ত অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে। সেন্ট মার্টিনকে আধুনিক পর্যটন সুবিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে বৈধভাবে অর্জিত অর্থ এ তহবিলের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের বৈধ আয় থেকেও একটি অংশ এ তহবিলের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সংস্থার স্কলারদের সমন্বয়ে এবং দু-একজন বাংলাদেশি উপযুক্ত প্রতিনিধিকে উক্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্বমানের একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যারা তিন কিংবা পাঁচ বছর অন্তর নীতিমালা অনুসরণপূর্বক সারা বিশ্বের সমস্ত কর্নার থেকে সৃষ্টিশীল সেরা মানুষকে বিবেচনায় নিয়ে, যথাযোগ্য যাচাই-বাছাই ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, যেকোনো ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানজনক ও মূল্যবান ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পুরস্কার’-এ চূড়ান্তভাবে ভূষিত করবেন বিশ্বসেরা পাঁচ থেকে দশজনকে।

প্রস্তাবনার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালের মধ্যে এমন একটি পুরস্কার প্রবর্তন করা গেলে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আধুনিক বাংলার রূপকার বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা মানুষের মনে মনে, প্রাণে প্রাণে, সর্বোচ্চ সম্মান-শ্রদ্ধা ও মর্যাদা নিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্ব যতদিন থাকবে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিয়ে বেঁচে থাকবেন অন্তত ততদিন, হয়তো তারও পরে।

লেখক : পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!