• ঢাকা
  • বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

যেভাবে একজন নেতা কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন


ড. শফিক আশরাফ জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ১২:৩৫ পিএম
যেভাবে একজন নেতা কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন

ঢাকা : বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির সাম্প্রতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি কিংবদন্তির নাম। আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ তার কথাটি উচ্চারণ করেন এভাবে : ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি/আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি/তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল’।

পিঠে ক্ষত এবং বুকে ভালোবাসা দিয়ে একটি জাতির প্রতি একজন নেতা প্রেরিত হয়। কোনো কোনো জাতিকে এজন্য শত বা হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সৌভাগ্যবান বাঙালি জাতি ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পরেই এরকম একজন নেতা পেয়ে যায়। যার হাত ধরে বঞ্চিত লাঞ্ছিত বাঙালি খোলা জানালা দিয়ে মুক্ত আকাশ, অবারিত সবুজ মাঠ দেখে অভিভূত হয় এবং বুকভর্তি আশা-আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়। মোগল, পাঠান, ব্রিটিশদের শোষণের পর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ বঞ্চনায় পুরোদমে আশাহত বাঙালি জাতির সামনে শেখ মুজিবুর রহমান যে আশার মশাল প্রজ্বলন করেন তাতে তিনি খুব সহজেই সাধারণ জনমানুষের কাছে স্বপ্নের রাজপুত্র হিসেবে উপস্থাপিত হন। ফলে একটি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গোটা জাতি তাকে মেনে নেয় এবং নেতার প্রতি অনুগত জাতিও তার মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ বিশ্বাস করে এবং প্রতিটি বাক্য মেনে নেয়। এখানে তার নেতৃত্ব-শক্তি একজন ‘জোয়ান অব আর্ক’ কিংবা ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’ অথবা ‘চে গুয়েভারা’র চেয়ে কম নয়।

বাঙালি জাতির স্বপ্নের এই রাজপুত্র এবং জন্মনেতা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই ২৩ বছরে তাকে মোট ১৭ বার জেল-জুলুম সইতে হয়। এর মধ্যে দুঃখজনক ঘটনা হলো, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট ঘোষণা করে এবং তাদের ন্যায্য দাবির প্রতি সর্মথন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। কর্মচারীদের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিভাবে তাকে জরিমানা করে এবং তিনি এ অন্যায় নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। দীর্ঘ প্রায় ষাট বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় তার অন্যায় আদেশ বুঝতে পারে এবং ২০১০ সালে এসে সেই আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় কিন্তু ততদিনে আমরা আমাদের স্বপ্নের রাজপুত্রকে হত্যা করে এবং পিতৃহত্যার অভিশাপে অভিশপ্ত জাতি হিসেবে গোটা পৃথিবীর সামনে আজীবনের জন্য মাথা নত করে বসে আছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গা যেখানে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি ও মুক্তজ্ঞান চর্চা হবে, সেখানে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে কেন ব্যবহূত হবে? বঙ্গবন্ধুর ঘটনা এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ মাত্র।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পরেই ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই জাতি বিভক্তির তত্ত্ব সঠিক ছিল না। ভাষা নিয়ে আন্দোলন করতে বাংলার মানুষকে রাস্তায় নামতে হয় দেশ বিভক্তির বছর না পেরোতেই। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষার জন্য বিক্ষোভ করতে গিয়ে সচিবালয়ের সামনে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে বিভিন্ন কারণে তাকে এই গ্রেপ্তার ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে আবার যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। অবশ্য পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৫৭ সালের ৩০ মে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। আর এ সবই ছিল গোটা জাতির ভার নিজ কাঁধে তুলে নেওয়ার প্রস্তুতিমাত্র। সত্তরের নির্বাচনের অভাবনীয় সাফল্যের মাধ্যমে ভার তুলে নেওয়ার কাজটা পুরোপুরি সম্পন্ন হয়। ৭ মার্চের নির্ভীক ও চূড়ান্ত ঘোষণার মাধ্যমে জাতি উপলব্ধি করে দুঃখী জাতির ভার বহন করতেই আগমন ঘটেছে এরকম একজন নেতার এবং এই নেতার জন্যই বাঙালি হাজার বছর ধরে পথ চেয়ে বসে আছে। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বঙ্গবন্ধু লাখ লাখ জনগণের সামনে তার স্বপ্নের কথা বলেন, স্বপ্নভঙ্গের কথা বলেন। আর এরই ফলে ২৫ মার্চ রাত ১টা ১০ মিনিটে স্বপ্ননেতাকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ২৬ মার্চ গভীর রাতে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে বাঙালি জাতি। হাতে যা আছে তা-ই নিয়ে প্রতিরোধে নেমে পড়ে। অপরদিকে পাক-হানাদার এবং রাজাকাররা মিলে গোটা দেশকে একটা নরক করে তোলে। অন্যদিকে পাকিস্তানি জেলখানায় স্বপ্নদ্রষ্টার বন্দিজীবন কাটে ৯ মাস ১৫ দিন। পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তল্পিবাহক হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর কেশাগ্র স্পর্শ করতে সাহস পায়নি।

দেশ স্বাধীনের পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে সদম্ভে, মাথা উঁচু করে মাতৃভূমিতে ফিরে আসে বাঙালির স্বপ্নপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন বঙ্গবন্ধু এবং মাটিকে  কর্ষিত করেন, স্বপ্নফসল উৎপাদনের কাজে জাতিকে আহ্বান করেন। কিন্তু দুর্দশার কালো চাঁদ আমাদের ছেড়ে যায়নি। দেশের কুসন্তান, মাতৃভূমির কীটেরা তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে এবং এদের সহযোগিতা করতে পলাশীর প্রান্তর থেকে মীর জাফরের মতো উঠে আসে তৎকালীন সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সাথে প্রথম বেইমানি করে তারা এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রধানদের পুনর্বাসন করা হয়। রাজনীতিতে ধর্মের উগ্রতা এবং শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তাদের প্ররোচনায় অষ্টম শ্রেণি, এসএসসি সর্বোচ্চ দ্বাদশ শ্রেণি পাস কিছু অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষরূপী পোশাকধারী পশু বাঙালির স্বপ্নের রাজপুত্রকে হত্যার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্নদা শঙ্কর রায়ের কলম দিয়ে অশ্রু ঝরে এভাবে : ‘নরহত্যা মহাপাপ তার চেয়ে পাপ আরো বড়/করে যদি তার পুত্রসম বিশ্বাসভাজন/জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তার নিধন।/নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর/সারাদেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোরপাপের/যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করো অপরাধ ক্ষমা/কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা/একদা বিবর্ণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের। ...বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকোনা নীরব দর্শক,/ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক।’

অথচ বঙ্গবন্ধুর মানবতাবোধ ও মানবপ্রেম ছিল তুলনাহীন। তিনি অকপটে বলতেন, ‘ওদের নিয়েই আমার সব, আমার দেশের মানুষই আমার শক্তি।’ তিনি জনগণের স্বার্থে কোনো রকম আপস না করায় পাকিস্তান আমলের দশ বছর তাকে জেলে কাটাতে হয়। তার প্রস্তাবিত বিভিন্ন দফা এবং ভাষণ বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয় যে, বাংলার মানুষের মুক্তিই ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য। তিনি বাল্যকাল থেকেই খুব সুন্দর করে সাজিয়ে কথা বলতে পারতেন। তার বক্তব্য সাবলীল ও যুক্তিগ্রাহ্য ছিল। ফলে মানুষ তন্ময় হয়ে শুনত। বয়সের সাথে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পায়। এতে পৃথিবীর ইতিহাসের নানান প্রসঙ্গ তার কথায় প্রকাশ পেত। তার সব বক্তৃতাতেই প্রকাশ পেয়েছে বাংলা, বাঙালি এবং দুঃখ-দুর্দশায় নিমগ্ন খেটে খাওয়া নিপীড়িত জনমানুষের কথা। মানুষের প্রতি এই প্রেম এবং সর্বজনীন সমস্যার প্রতি দৃষ্টি স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই প্রকাশ পেয়েছে। যেমন তিনি মিশন স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক স্কুল পরির্দশনে যান। বঙ্গবন্ধু তাকে সংবর্ধনা জানান এবং স্কুল হোস্টেলের ভাঙা ছাদ মেরামতের দাবি জানান। মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসিকতায় মুগ্ধ হন এবং স্কুল হোস্টেলের ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা করে দেন।

‘তার এক ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সহ-সভাপতি শামসুর রহমান মানির মুখে শোনা যায়, তিনি ক্ষেতে-খামারে কর্মরত মানুষের কাছে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলতেন। কিষানেরা কিছুক্ষণের জন্যে হলেও কাজ বন্ধ রেখে তার কথা শুনতেন।’ তার এই দেশ ও মানবপ্রেম ক্রমান্বয়ে প্রগাঢ় হয়। দেশ স্বাধীনের পর যখন এক বিদেশি সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী?’ তিনি উত্তর দেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।’ তিনি যখন আবার প্রশ্ন করেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় দোষ কী?’ তিনি উত্তর দেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ তিনি সেই নেতা যার দোষ এবং গুণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল। তার এই অত্যধিক ভালোবাসা ও বিশ্বাসকেই মৃত্যুর কারণ বলে মনে করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তার প্রাণ হু হু করে কেঁদে উঠেছে। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে স্বাধীনতার পরপরই রেসকোর্সে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখেন, ‘আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালীও প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। অতঃপর বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি বাংলাদেশের এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি। আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশা না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না।... বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না, করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযোগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ বুকের ভেতর দেশের মানুষের প্রতি সত্যিকারভাবে অকৃত্রিম দরদ এবং ভালোবাসা না থাকলে এই কথাগুলো এভাবে বলা সম্ভব নয়। তার মানববোধ ও মানবপ্রেমের উদাহরণ উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ পেয়েছে।

আরো কত যুগ বা কত শত বছর একজন শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য একটি জাতিকে অপেক্ষা করতে হবে? আমরা সত্যিই তা জানি না!

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
[email protected]

 

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!