• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

পাটশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে


ফারিয়া ইয়াসমিন জানুয়ারি ৩০, ২০২১, ০৩:৪৬ পিএম
পাটশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে

ঢাকা : অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য শিল্পের বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, তবে শিল্পের বিকাশও ঘটেছে। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের মতো বাংলাদেশও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে শিল্পের উন্নতি করতে। পাটশিল্প বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প। পাটশিল্প হলো বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভারী শিল্প, যা ব্রিটিশ শাসনামলে এবং পাকিস্তান আমলে ছিল একক বৃহত্তম শিল্প। বর্তমান বিশ্বের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের বৃহদাংশই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা মোট বিশ্ববাজারের প্রায় ৬৫%। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার হলো এই পাটশিল্প তবে কিছু সমস্যা জর্জরিত হয়ে পাটশিল্প কিছুটা কমে গেছে। যার ফলে পাটশিল্পের গতি কিছুটা স্থবির হয়ে যাচ্ছে যেটা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখবর নয়।

পাটশিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সালে মাওয়া জুট মিলস লি. স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এটা ছিল নারায়ণগঞ্জে স্থাপিত বাংলাদেশের প্রথম পাটকল। পরবর্তী সময়ে একই জায়গায় স্থাপিত হয় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী পাটকল। এর পরপরই কয়েক বছরের মধ্যে গড়ে ওঠে অসংখ্য শিল্পকারখানা। তারপর থেকে শুরু হয় পাটকলের অগ্রযাত্রা যে অগ্রযাত্রা বর্তমান অবস্থায়ও চলমান রয়েছে, তবে  তা কিছুটা স্থবির হয়ে গেছে।

বর্তমানে পাটশিল্পের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। এক সময় পাট ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে অর্থকারী ফসল। শুধু তাই নয়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত। কিন্তু সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বর্তমানে পাটশিল্পের অবস্থা মৃতপ্রায়। অন্যান্য বিশ্ব যখন কৃত্রিম তন্তু বাদ দিয়ে পাট ও তুলাকে প্রাধান্য দিচ্ছে আমরা তখন এই শিল্পকে নিজ হাতে দমিয়ে রাখতে ব্যস্ত। এটা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু না। স্বাধীনতার পর পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রপ্তানি আয়ের ৮৭ শতাংশ আসত, যা আজ সিঙ্গেল ডিজিটে রূপান্তরিত হয়েছে।

দেশের অর্থনীতি যেখানে ক্রমেই এগিয়ে যাওয়ার লড়াই করছে সেখানে এমন একটা বৃহত্তর শিল্পের স্থবিরতা সংশয়ে ফেলছে সকলকে। দেশে যদি আমদানির থেকে রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হয় তাহলে পাটশিল্পের মতো বড় একটা শিল্পের অগ্রগতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাটশিল্পের অগ্রযাত্রার পরে এই শিল্পের অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও বর্তমানে শিল্পের অবস্থা আশঙ্কাজনক যেটা থেকে অতি দ্রুত উত্তরণ প্রয়োজন।

১৯৭২ সালে ৬৭টি ব্যক্তি মালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকল তদারকি, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন’ গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া পাটশিল্পকে আরো সুদূরপ্রসারী করতে ১৯৭৪ সালের অ্যাক্টের মাধ্যমে দেশের অন্যতম প্রাচীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বর্তমান ‘বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়।  তবে কিছুদিনের মধ্যেই এগুলোর অনাগ্রহতা প্রকাশ পায়, যার ফলস্বরূপ পাটশিল্পে বর্তমান নানা সমস্যা বিদ্যমান।

দুর্নীতি, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অবহেলার কারণে একের পর এক পাটকল বন্ধ হতে থাকে। এ ছাড়া শ্রমিককে ঠিকমতো মজুরি না দেওয়ার ফলে এই শিল্পের ওপর থেকে তাদের আগ্রহ কমতে থাকে। যার ফলে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। পাটকলগুলো বন্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে লোকসান। তবে সরকারি পাটকল বন্ধের ক্ষেত্রে কারণ হলো কাঁচা পাট কেনায় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। এ ছাড়া অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হলো, উৎপাদন কম কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি। সরকারি পাটকলগুলোতে যন্ত্রপাতি পুরনো হওয়াতে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারি পাটকলগুলোতে আগের থেকে অবস্থা অনেকটা ভালো লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও ভূমি পাট চাষের জন্য উপযোগী হলেও দিন দিন চাষিদের পাট চাষের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অনেকে পাট চাষ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে, তবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো যায় বলে এখনো এর চাহিদা রয়েছে তাদের কাছে।

৯০ দশকে এ দেশে পাট উৎপাদন হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ক্রমে সেই পাটের জমির পরিমাণ কমতে কমতে ৩০-৪০ বছর ধরে ৪ বা সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। পরে পরিবেশ সচেতনতা, প্রাকৃতিক আঁশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির কারণে সেই জমির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৭-৮ লাখে এসেছে। তবে অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তার উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে।

পাটশিল্প বরাবরই বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। এই শিল্পের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দিতে হবে। করোনা মহামারীতে যেখানে সব ক্ষেত্রে ধস নেমেছে সেখানে পাটশিল্পের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পাটশিল্পের ক্ষেত্রে বিদ্যমান যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলোকে দূর করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। পাটশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারলে রপ্তানি খাতে এক উজ্জ্বলময় ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারবে। বাংলাদেশ সরকারি পাটকলগুলোতে আরো বেশি নজর দিতে হবে সেখানে বিদ্যামান শ্রমিক সমস্যা, অদক্ষতা, দুর্নীতি এগুলোকে প্রতিহত করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য পাটশিল্পকে টিকিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!