ঢাকা : তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা আমরা ভোগ করছি। বিশ্বব্যাপী তথ্যের অবাধ প্রবাহও আমরা টের পাচ্ছি। একসময় যে-কোনো বিষয়ে জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হতো সঠিক মানুষ অথবা বইয়ের জন্য। প্রযুক্তি সেই অভাব দূর তো করেছেই, বরং হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সব। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন একটি ‘ক্লিক’ করলেই হুকুম শোনে আলাউদ্দিনের দৈত্যের মতো, তথ্য আমাদের সামনে হাজির হয়। সেখান থেকে খুঁজে, সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্যটি বেছে নেবার মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হয়। করোনভাইরাস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সামনে তথ্য আসে দুই হাজার উনিশ সালের শেষে। তখন চীনে ভাইরাসটি প্রকোপ দেওয়ায় করোনাভাইরাস সম্পর্কে তথ্য সাধারণের সামনে প্রকাশ্য হতে থাকে। ভাইরাসটি এ সময়ে চিহ্নিত হয় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ও প্রাণঘাতী হিসেবে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকায় ভাইরাসটি আলোচনায় চলে আসে। এরপর করোনার সংক্রমণ ক্ষমতা, প্রাণনাশের ক্ষমতা দিয়েই সে বিশ্বের নানা প্রান্তে তার অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করে। তার জানান দেওয়ার ধরন ও ক্ষমতা এতটাই প্রবল ছিল যে, প্রবল পরাক্রান্ত মানুষ—তাকেও আশ্রয় নিতে হয় ঘরে। দীর্ঘদিন নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করে রাখতে হয়। বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থা, অর্থনীতির চাকা—সবই থমকে যায়। কিছুই স্বাভাবিক থাকে না। এসব খবর আমাদের কারো কাছেই অজানা না। শুধু তাই নয়, আমরাও এর শিকার। আমাদেরও কয়েক মাস স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়েছে। আমরাও বন্দি থেকেছি ঘরে। আমরাও হারিয়েছি স্বজন, প্রিয়জন।
কিন্তু আমরা তা মনে রাখিনি। কারণ বিস্মৃতিপরায়ণ প্রাণী হিসেবে আমাদের সুনাম রয়েছে। আমরা ভুল থেকেও শিক্ষা নিই খুব কম সময়েই। ফলে যাই যাই করে করোনাভাইরাস যখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসেছে বলে আমরা মনে করেছি, তখন বাঁধন আলগা করে দেওয়ায় করোনাভাইরাস আবার ফিরে আসে। আর এবারে তার এই ফিরে আসা আরো প্রাণঘাতী, আরো ভয়ংকর রূপ প্রকাশ করছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, চলতি মাসে মহামারী করোনাভাইরাসের ভয়ংকর রূপ দেখছে পুরো বিশ্ব। পরিসংখ্যান বলছে চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনেই বিশ্বে শনাক্ত হয়েছে ৬৫ লাখের বেশি নতুন রোগী। আর এ সময়ে মারা গেছে ১ লাখ ৯ হাজার মানুষ। করোনার এই রুদ্রমূর্তি দেখে অনেকেই সতর্ক হয়েছেন। অনেক দেশেই নতুন করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। আমরাও পিছিয়ে নেই। আমাদের সরকারও সাধারণের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করছেন। তারই অংশ হিসেবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আসে লকডাউনের ঘোষণা। অনেক বিষয়েই কঠোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। এসবের উদ্দেশ্য একটিই, তা হলো মানুষ যেন ভালো থাকে, নিরাপদ থাকে, সুস্থ থাকে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তা বলছে না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে সাধারণের অসতর্কতাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ইতোমধ্যে দেশে দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ডও প্রায় প্রতিদিনই ভাঙছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগীর স্বজনদের হাহাকার। ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর জন্য প্রয়োজন হাসপাতালে বিশেষায়িত বেড। যার সংকট ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে ইতোমধ্যে সংকটাপন্ন করোনা রোগীর জন্য জরুরি বিশেষায়িত বেড, আইসিইউর সংকট দেখা দিয়েছে। হাহাকার শুরু হয়েছে আইসিইউ বেডের জন্য। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অবস্থা তুলে ধরে একটি দৈনিকের প্রতিবেদন বলছে, করোনা রোগী অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক হলেও হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরেও স্বজনরা আইসিইউ জোগাড় করতে পারছেন না। আইসিইউ শয্যার জন্য গোটা জেলায় হাহাকার চলছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রামে আইসিইউয়ের সংখ্যা বিশটি, রাজধানীতে করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনার হাসপাতালের আইসিইউ শয্যার সংখ্যা ১০৮টি। তবে এখন যেভাবে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ক্রমশ অপ্রতুল হয়ে উঠছে। শুধু চট্টগ্রাম বা রাজধানী ঢাকাই নয়, বর্তমান অবস্থায় আইসিইউ সংকট সারা দেশেই। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ১৫ জেলায় কোনো আইসিইউই নেই। অথচ করোনার সংক্রমণের প্রথম দফাতেই আমরা জেনেছিলাম, করোনা মোকাবিলার সময়ে সংকটাপন্ন রোগীকে বাঁচাতে প্রয়োজন আইসিইউ। তখনো আমাদের যথেষ্ট সংখ্যক আইসিইউ ছিল না। পরিস্থিতি বিবেচনায় গত বছরের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাও বাড়াতে বলেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও দেন। তার সেই নির্দেশ প্রদানের পর ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে দশ মাস। এত দিনে এসে জানা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন হয়নি, জেলা পর্যায়ের অনেক হাসপাতালগুলোতে এখনো আইসিইউ ইউনিট তৈরি হয়নি। খবরটি উচ্চ করোনা সংক্রমণের এ সময়ে বেদনার। আবার তড়িঘড়ি করে এখন আইসিইউ স্থাপন হলেও আইসিইউ পরিচালনা করার মতো প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স সবখানে রয়েছে কি না এ প্রশ্নটিও অবান্তর নয়। এ ক্ষেত্রে যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স থেকে থাকেন, তা স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য সাধুবাদ বয়ে আনবে। বিপরীতে যদি প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স না থাকে তাহলে প্রথম দফা করোনার ঢেউ মোকাবিলার পর দ্বিতীয় দফার প্রস্তুতির জন্য লোকবলের ঘাটতি পূরণের ব্যর্থতায় স্বাস্থ্য বিভাগের নিন্দাবাদও প্রাপ্য।
করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ে আমাদের প্রস্তুতি ছিল কম; কিন্তু সতর্কতা ছিল বেশি। আমাদের ভয় ছিল, শঙ্কা ছিল যা আমাদের সচেতন করেছে। ফলে সংক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করতে পারেনি। মানুষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে গিয়েছে কম। প্রথম দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণার সময়ে আতঙ্কিত মানুষ বাসস্থান ছেড়ে ছুটেছে গ্রামে—নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। অজানা সময় ঘরে বন্দি থাকাটা যেন নিকটজনের সান্নিধ্যে হয়, এ ভেবেও ছুটেছে অনেকে। এবারে তো সে অবস্থা হবার কথা নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের সতর্কতা ও সচেতনতা তো আরো বেশি হবার কথা। কিন্তু ঘটছে উল্টো। দ্বিতীয় দফা করোনার সংক্রমণের তীব্রতা ঠেকাতে সরকার ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে লকডাউন ঘোষণা করে। সাত দিনের এ লকডাউন, তথা কঠোর নিষেধাজ্ঞা শেষ হয় এপ্রিলের ১১ তারিখ। পরে ১৩ তারিখ পর্যন্ত বহাল রাখা হয় এই নিষেধাজ্ঞা। ১৪ তারিখ, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন থেকে শুরু সর্বাত্মক লকডাউন। অথচ এবারো লকডাউন উপেক্ষা করে, যেখানে গণপরিবহন বন্ধ, সেখানেও পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ, সিএনজি, অটোরিকশায় করে মানুষ শহর ছেড়েছে। দোকানে, বাজারে, শপিংমলে, ব্যাংকেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। ১২ ও ১৩ এপ্রিল যেভাবে ব্যাংকে, বাজারে, দোকানে মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে তা যে-কোনো উৎসবকেও হার মানায়। সাত দিনের লকডাউনের ঘোষণা আসবে—এ কথা শুনেই যেন মানুষ বাড়ি থেকে বেরুতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যেন একদিনেই সব মানুষকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে। যেন একদিনেই গাদাগাদি সবাইকে বাজারে যেতে হবে—পুরো বাজারসুদ্ধ নিয়ে আসতে হবে বাড়িতে। এই মানসিকতার পেছনের কারণ হয়তো মনোবিদরা বলতে পারবেন, তবে এটা আমাদের মনের অসুস্থতারই প্রকাশ।
এই অসুস্থ মানসিকতা, আমাদের অকারণে বাইরে বেরুনোর প্রবণতা—শুধু নিজেকে নয়, পরিবারকেও বড় বিপদের সম্মুখীন করে তুলতে পারে। তাই এখনই সতর্ক হওয়ার সময়। আজ আমরা যেমন এক ক্লিকে সকল তথ্য পাচ্ছি, তাতে তো এও জানতে পারছি করোনা আজ কতটা প্রাণঘাতী। ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাস কতবার তার গঠন পাল্টে নিয়েছে, সে খবরও আমাদের অজানা নয়। সেই জানাকেই এখন কাজে লাগতে হবে। তথ্য আমাদের সবার কাছেই, সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে জ্ঞানে পরিণত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারে তিনটি কারণে মৃত্যুর হার বেড়েছে। তার মাঝে প্রথম এবং প্রধান কারণ অসচেনতা, তথা করোনার প্রকোপকে গুরুত্ব না দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ হাসপাতালে দেরিতে যাওয়া এবং তৃতীয় ও শেষ কারণ হাসপাতালগুলোর সক্ষমতার অভাব। যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য আগে সমস্যা চিহ্নিত করতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের বড় সুবিধা, আমরা সমস্যা কোথায় তা জেনেছি। করোনার সংক্রমণ বাড়ার পেছনে প্রথম কারণটি সমাধানের পথ আমাদের হাতে। হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া রোগী দেখেও, সংবাদপত্রের বাইরেও প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এত এত মানুষের মৃত্যুর খবর দেখেও (অবশ্য তারা সবাই যে করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন—তা নয়) আমাদের যদি সচেতনতা তৈরি না হয়, তাহলে সরকারের সকল উদ্যোগই ব্যর্থ হবে। লকডাউন, কঠোর নিষেধাজ্ঞা, সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা এর সবই হবে বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।