ঢাকা : ফুল যেমন সৌন্দর্যের প্রতীক; তেমনি ফুল পবিত্রতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারও প্রতীক। কে ভালোবাসে না ফুলকে? সবাই ফুলকে ভালোবাসে। এখন তো ফুল ছাড়া জন্মবার্ষিকী, বিবাহ অনুষ্ঠান, বিবাহবার্ষিকী, সভা-সমাবেশ, সেমিনারের কথা চিন্তাও করা যায় না। ফলে ফুলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় কম-বেশি গোটা দেশেই এখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক হারে ফুলের চাষ হচ্ছে। অথচ এমন একসময় ছিল যখন বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে স্বল্প পরিসরে ফুলের বাগান করা হতো। মহান ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিতেই হবে। ছুটতাম মানুষের বাসাবাড়ির বাগানে বাগানে। ফুল সহসা কেউই দিতে চাইতেন না। শত অনুরোধে যা জুটত তার সঙ্গে দেবদারু গাছের পাতার তৈরি বেদিতে ২/৪টি ফুল গুঁজে দিয়ে শহীদ মিনারে ভোর বেলায় খালি পায়ে দিয়ে আসতাম। সে কী এক অনুভূতি! মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, নববর্ষে, বিশেষ করে বাংলা নববর্ষ যেন ফুল ছাড়া এখন কল্পনাতেই আসে না।
প্রয়োজন মানুষকে শিক্ষা দেয়, সৃষ্টি করতে শেখায়। অবশ্য মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, রুচিবোধের পরিবর্তনে ফুলের ব্যবহার বেড়েছে কল্পনাতীতভাবে। ফলে ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদও যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। কবি আজ সার্থক। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার ফুলের ফসল কবিতায় লিখে গেছেন, ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি,/ দুটি যদি জোটে অর্ধেক তার ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!’ হয়তো কবি বেঁচে থাকলে দেখতেন, এখন মানুষ ফুলকে কি পরিমাণ ভালোবাসে? এখন আর ক্ষুধা মেটানোর সঙ্গে ফুল কেনার সে সম্পর্ক নেই। যারা ফুল কিনে তাদের কাছে ফুল কেনার টাকার অর্ধেক অংশ রেখে খাবার কেনার প্রয়োজন নেই। কারণ এখন প্রতিদিনই কোটি কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হয়।
যদিও বৈশ্বিক মহামারী করোনার বিরূপ প্রভাবে গত ১৪ মাস ধরে ফুলচাষিদের দুর্দিন যাচ্ছে। ফুলের ব্যাপক চাষাবাদ করে ক্রেতার অভাবে মাঠেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার ফুল। অনেক ফুলচাষিই করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন ফুলচাষিরা। সর্বাত্মক অবরোধের কারণে তারা প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ফুল বেচতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, গদখালীর প্রায় ছয় হাজার ফুলচাষি ফুল বিক্রি করতে না পারায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, সবজির মতো ফুলের পাইকারি বাজারগুলো খোলা রাখার অনুমতি দিলে ফুলচাষিরা কষ্ট করে হলেও বাঁচতে পারত। শুধু গদখালীই নয়, ঝিকরগাছা, রংপুরসহ দেশের সর্বত্রই ফুলচাষিদের করুণ অবস্থা। ঝিকরগাছার ফুলচাষি শাহাজান আলী এ বছর ১৫ বিঘা জমিতে গোলাপ, জবা, রজনিগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, জারবেরা ফুলের চাষ করে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন। তিনি বলেন, কষ্টের বিষয় হচ্ছে, ফুল না তুললে নতুন করে আর কুঁড়ি আসে না। তাই গোলাপ ফুল কেটে ছাগল-গরু দিয়ে খাওয়াতে হচ্ছে। অথচ আগে সূর্য ওঠার আগেই প্রতিদিন চাষি, পাইকার, শ্রমিকের হাঁক-ডাকে মুখর হতো এসব এলাকা। বিশেষ করে ফুলের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত গদখালী বাজার। যশোর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে যশোর বেনাপোল মহাসড়কের পাশের এই এলাকায় দূর-দূরান্ত থেকে ফুল কিনতে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আসতেন। সকাল থেকেই বিভিন্ন রুটের বাসের ছাদে সাজানো হতো ফুল। তারপর সে ফুল ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যেত। হাড়িয়া নিমতলা গ্রামের ফুলচাষি আলতাফ হোসেন কষ্ট নিয়েই আক্ষেপের সুরে বলেন, আম্ফান ঝড় ও করোনাভাইরাস আমাদের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। আজ আমরা দিশেহারা, ক্ষেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে ফুল, বাধ্য হয়ে পশুকে খাওয়ানো হচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। অথচ স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখে ফুলবিক্রি করতে না পারায় অন্তত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম।
গত ২০ এপ্রিল জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশের খবর পত্রিকায় ‘বিপর্যয়ে গদখালীর ফুলচাষিরা’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে ফুলের স্বর্গরাজ্য যশোরের গদখালী, ঝিকরগাছার ফুলচাষিদের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা খুবই উদ্বেগের। শুধু গদখালী, ঝিকরগাছাই নয়, রংপুরের ফুলচাষিদের অবস্থাও তথৈবচ। রংপুরের আশপাশে প্রায় ১০০ ফুলের বাগান রয়েছে। শুধু গোলাপের বাগান আছে ২০টির মতো। গোলাপ ছাড়াও গ্লাডিওলাস, গাঁদা, রজনিগান্ধা, জবা, নাইনটাস, ইন্টারহেনা, গেজনিয়া ও ক্যালেন্ডালা ফুলও চাষ হয়েছে। যদিও যশোরের মতো ফুলচাষের অতীত ঐতিহ্য এখানে নেই। মাত্র কিছুদিন ধরে এ অঞ্চলে ফুলচাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফুল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. কবিতা আনজুমান বলেন, চাহিদাকে অনুসরণ করে এখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক ফুলের চাষ হচ্ছে এ অঞ্চলে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তবে এটা ঠিক, রংপুর অঞ্চলে এখন ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। কারণ ধানে, গমে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল। এ অঞ্চলে ধানচাষির সংখ্যা বেশি। কিন্তু ফুল চাষে লাভবান হওয়ায় ধানচাষিদের মধ্যে কেউ কেউ এখন ফুল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তবে এ বছর ফুলচাষিরা লোকসানের মুখে পড়ায় আবার এ খাতটি সম্প্রসারণে হয়তো কিছুটা বাধার সৃষ্টি হবে। তবে আমরা আশাবাদী, রংপুর অঞ্চলে ফুল চাষের উপযোগী জমিতে ধীরে ধীরে এ চাষের ব্যাপকতা বেড়ে যাবে। কারণ প্রয়োজন মানুষকে উৎপাদন করতে শেখায়। অর্থাৎ যে পণ্য উৎপাদন করে চাষি লাভবান হবেন, সে ফসলের দিকেই তারা ছুটবেন, এটাই স্বাভাবিক। এখন আধুনিকতা আর সভ্যতার প্রতীক হচ্ছে ফুল। ফলে ফুলের ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত গতিতে। যেহেতু ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেহেতু ফুলের চাষাবাদও বাড়বে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
একসময় ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদের কথা মানুষের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। না কোনোভাবে সে ফুলের চাষ শুরু হয়ে আজ তা বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করেছে। উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণন ও রপ্তানিতে সমন্বিতভাবে কাজ করলে এ শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় মাপের অবদান রাখতে সম্ভব হবে। অথচ ১৯৮৩ সালে ফুল অনুরাগী উদ্যোগী কৃষক মো. শের আলী মাত্র ৮৩ শতাংশ জমিতে বাণিজ্যিক ভাবে ফুল চাষ শুরু করেন। সেখানে এখন গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে ব্যাপকভাবে ফুলের চাষাবাদ হচ্ছে। ফুল চাষ করে এ অঞ্চলের মানুষের সমৃদ্ধিও এসেছে। দিন দিন ফুলচাষির সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে এখন শুধু যশোর, ঝিকরগাছাই নয়, দেশের প্রায় ২৪টি জেলায় প্রায় ৩,৫০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষাবাদ হচ্ছে। ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ২৫ হাজার কৃষক। ফুল ব্যবসা ও বিপণনে জড়িত আছেন অন্তত দেড় লক্ষ মানুষ। আর এ খাতে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে প্রায় ৭-৮ লাখ মানুষ এখন জড়িত। যাদের রুটি-রুজি সবকিছুই এই ফুল চাষ ও ফুল ব্যবসা, পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত। অথচ গত ১৪ মাস ধরে এ খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ফুলচাষিদের চরম মূল্য দিতে হবে। আবার ফুল চাষ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা রয়েছে।
এ শিল্প আজ বহুবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশেষ করে ফুল উৎপাদনে প্রযুক্তির ওপর কৃষকের যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব, অতিরিক্ত মূলধন ব্যয়, মানসম্মত বীজ ও চারার অভাব অন্যতম। মূলত ভারত থেকে ফুলের বীজ আমদানি নির্ভরতা, গ্রিনহাউস নির্মাণের প্রয়োজনীয় দ্রবাদির অপ্রাপত্যতা, ফুল চাষের উপযোগী কম্পাউন্ড সারের অভাব, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে স্থায়ী পাইকারি ফুলের বাজারের অভাব, ফুল নিয়ে গবেষণার অভাব এবং সর্বোপরি একটি জাতীয় ফুলনীতি না থাকা। অথচ এই শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে হলে শুল্কমুক্ত সুবিধার বিভিন্ন দেশ থেকে ফুলের বীজ আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এমনকি সংরক্ষণ উপযোগী ছোট-বড় হিমাগার তৈরি করে ফুলকে বিনষ্টের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি ফুল পরিবহনের জন্য শীতাতাপনিয়ন্ত্রিত কাভার্ডভ্যান ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আবার স্বল্প সুদে সহজ শর্তে ব্যাংকগুলো থেকে ফুলচাষিরা যেন দ্রুত ঋণ নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ সরকারি প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত কোনো শিল্পই সমৃদ্ধ হতে পারে না। এ কারণে সম্ভাবনার যে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে, এটিকে মহরুহে পরিণত করতে হলে অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে এসে প্রয়োজনীয় করণীয়গুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে ফুল যেমন দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবে; তেমনি পারিবারিক, সামাজিক জীবনে ফুলের কদর বাড়লে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধও সমৃদ্ধ হবে। ফুলকে ভালোবাসতে শিখলে মানুষকেও ভালোবাসার এক সেতুবন্ধন তৈরি হবে, যা কেবল ফুলের ব্যবহার বৃদ্ধি করেই অর্জন করা সম্ভব। অর্থাৎ মানুষের মননশীলতা, নৈতিক মূল্যবোধ, চরিত্র গঠন ও মানুষে মানুষে সম্পর্ক অটুট রাখতে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিতে ফুলের ব্যবহারকে গোটা দেশেই ছড়িয়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে ৫ থেকে ৭ ধরনের ফুল সৌদি আরব, দুবাই, জর্ডানসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আবার ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে বিমানে ফুল আমদানিও হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের মতে, যেহেতু প্রতি বছর গোটা বিশ্বে ফুলের বাজার ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেহেতু ফুল রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে ফুল উৎপাদন করলে আমরাও প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হব। পাশাপাশি ফুল চাষাবাদকে সম্প্রসারিত করে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও সম্ভব। বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে, এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক : সমাজকর্মী
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।