• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

বাংলাদেশের শিক্ষা : প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব—এক


গৌতম রায় মে ১৯, ২০২১, ০৪:২৪ পিএম
বাংলাদেশের শিক্ষা : প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব—এক

ঢাকা : ৫০ বছর পার করে ৫১ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ। এ সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা কতটুকু এগিয়েছে, কোথায় আরো উন্নতির প্রয়োজন এবং বর্তমান অবস্থার নিরিখে ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে কী কী করা দরকার, সেগুলো আলোচনা করা যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই আলোচিত হবে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাবও। আলোচনাটি এজন্য প্রয়োজন যে, শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ যেভাবে গতিশীলতা দেখিয়েছে, একইভাবে নানা বিষয়ে প্রত্যাশিত মান ও গুণ এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি। একদিকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় প্রবেশের যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেছে, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ রূপকল্প ২০৪১-এর মাধ্যমে উন্নত দেশের কাতারে শামিল করার নানা প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। উন্নয়নের এই যাত্রায় শিক্ষার অবদান কতটুকু এবং শিক্ষার উন্নয়ন কতটুকু হলো বাংলাদেশে?

একটি দেশের বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক পরিবর্তনের অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা। বলা হয়, শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ একটি দেশের উন্নতিতে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি উন্নতির ক্ষেত্রগুলোকেও স্থায়ী রূপ প্রদান করে। শিক্ষা যেহেতু প্রতিটি খাতের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাই শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ দৃশ্যমান উন্নতির পাশাপাশি প্রতিটি খাতেই অদৃশ্যমান উন্নতির ধারাকেও শক্তিশালী করে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার অর্জনগুলো লিপিবদ্ধ থাকা যেমন প্রয়োজন; তেমনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য ঘাটতিগুলোও চিহ্নিত করা জরুরি। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা উপাদানে অব্যাহতভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। সেগুলো শিক্ষার উন্নতির পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার বেশ কিছু বিষয়ে এখনো পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

প্রথমেই বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রের অর্জনগুলো আলোচনা করা যেতে পারে। এই তালিকায় সর্বাগ্রে যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে সেটি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায় নানা সাফল্য। এটি অনস্বীকার্য যে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষার যে কোনো স্তরের তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষাকে যৌক্তিক কারণেই অধিক গুরুত্বপ্রদান করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ছত্রিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে প্রথম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আরো অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে নানা প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ‘সবার জন্য শিক্ষা’কে গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যার প্রভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ ভর্তির লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে এই শতভাগ ভর্তির বিষয়টি বাংলাদেশ এমনভাবে বাস্তবায়ন করেছে যে, এটি সারা বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহূত হয়। শতভাগ ভর্তির পাশাপাশি এতে জেন্ডার সমতাও অর্জিত হয়েছে যা নারী শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। শুধু প্রাথমিকেই নয়, মাধ্যমিক স্তরেও ভর্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি জেন্ডার সমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ; যদিও উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ও গুণগত মান নিয়ে আরো প্রচুর কাজ করার সুযোগ রয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও নারী শিক্ষার প্রসারের বিষয়টিও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জন। যদিও এসব অর্জন যতটুকু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য প্রযোজ্য, উচ্চশিক্ষার জন্য ততটুকু প্রযোজ্য নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই পঞ্চাশ বছরে শিক্ষার নানা বিষয় নানাভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। শিক্ষা যে উন্নতির পথ মানুষ এটি উপলব্ধি করতে পেরেছে। এই ধারাবাহিক উন্নতির অংশ হিসেবে বর্তমানে দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়েছে; যেটি শিক্ষার ভিতকে সুসংহত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

সফলতা রয়েছে আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রে। ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বছরের প্রথম দিন বই দেওয়া এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। বাংলাদেশে এমন সময়ও ছিল যখন নতুন ক্লাসে ওঠে বই পেতে পেতে শিক্ষার্থীদের দুই থেকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হতো। যেখানে নানা ছুটি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে পাঠ্যসূচি শেষ করার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যেত না, সেখানে বিলম্বে শিক্ষাবর্ষ শুরু শিক্ষার্থীদের অনেকটাই পিছিয়ে রাখত। এ অবস্থা থেকে মুক্তি মিলেছে এবং এটি এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যাকে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বড় সফলতা হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। একইভাবে মুক্তি মিলেছে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার অন্তত তিন মাস পর ফলাফল প্রকাশের বিড়ম্বনা থেকে। এখন তুলনামূলকভাবে দ্রুত ফল প্রকাশ করায় কিছুটা হলেও সময়ের অপচয় থেকে রক্ষা পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় বই প্রদান করাও একটি দারুণ উদ্যোগ। বাংলার ভাষার পাশাপাশি গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও সাদরি ভাষাতেও শিক্ষার্থীদের বই প্রদান শুরু হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে অবস্থানরত সব ভাষাভাষীর সব স্তরের জন্য মাতৃভাষায় বই প্রদানের বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি, কিন্তু যে ধারাটি শুরু হয়েছে, সেটি ইতিবাচক। আশা করা যায়, শিগগিরই বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থী মাতৃভাষায় বই পাবে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করবে। এরকম ছোট-বড় অনেক সফলতা মিলেই বাংলাদেশের শিক্ষা ৫০ বছরে এগিয়েছে।

সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও কম নয়। শিক্ষা বাজেটের কথাই শুরুতে বলা প্রয়োজন। ইউনেস্কোর পরামর্শ অনুসারে বলা হয়, একটি দেশে শিক্ষার যথাযথ উন্নতির জন্য জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বা জাতীয় আয়ের ছয় শতাংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ বিষয়ে বরাবরই এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে। যদিও প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দের দাবি করা হয়; কিন্তু শিক্ষার জন্য বরাদ্দ কখনোই প্রত্যাশিত ছয় শতাংশের কাছাকাছি যায় না। শিক্ষা বাজেটের সাথে প্রযুক্তি, সংস্কৃতি বা অন্য কোনো ক্ষেত্রকে যুক্ত করায় শিক্ষা বাজেটকে সর্বোচ্চ মনে হলেও এতে আদতে এই বাজেট চাহিদার তুলনায় অনেক কম। শিক্ষা বাজেট গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, ২০১০ সালে যে জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নের জন্য হলেও বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। বৈশ্বিক বাস্তবতা ও জাতীয় প্রয়োজনের যে প্রতিফলন দেখা গেছে শিক্ষানীতিতে, সেটি বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য শিক্ষা বাজেটের ঘাটতিকে অন্যতম হিসেবে দায়ী করা যায়।

বাজেট প্রসঙ্গে শিক্ষানীতির কথা এসেছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম যে শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন, সেই কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করলেও বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতির যে পরিবর্তন ঘটানো হয়, তারই ধারাবাহিকতা হিসেবে ২০০০ সালের পূর্বে, অর্থাৎ দীর্ঘ ত্রিশ বছর বাংলাদেশ কোনো শিক্ষানীতি পায়নি। বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাংলাদেশের দ্বিতীয় শিক্ষানীতি। বহুল প্রতীক্ষিত এই শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উক্ত শিক্ষানীতি অনুসারে পরিচালিত হবে এবং তা সার্বিকভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু দশ বছরেরও বেশি সময় পার হওয়ার পর শিক্ষানীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ও কৌশলগুলো বাস্তবায়িত না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সময়ের প্রয়োজনে বিশদ শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন থেকেও আমরা অনেকটা দূরে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা আইন তৈরি ও তা বাস্তবায়নের বিষয়টিও ঝুলে রয়েছে। যদিও খসড়া শিক্ষা আইন তৈরি হয়েছে এবং এই খসড়ার ওপর নানা পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত আইনটি বাস্তবায়িত হয়নি। আইনটিতে যেসব বিষয়ে কঠোর অবস্থা নেওয়া হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, সেগুলো শেষ পর্যন্ত কীভাবে বাস্তবায়িত হয় তাও দেখার বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং ও নোট বা গাইড বই এই আইনে কীভাবে রাখা হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। শিক্ষা আইনের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত প্রচলিত খারাপ বা বিতর্কমূলক চর্চাগুলো যেন শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূর হয়, সেগুলোর প্রতি নজর দেওয়া। সেটি না হলে শিক্ষা আইন কতটুকু কাজে আসবে, তাও পর্যালোচনার দাবি রাখে।

লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!