ঢাকা : করোনা ভাইরাস বাংলাদেশকে প্রথম কামড় দিয়েছিল গত বছর অর্থাৎ মার্চ ’২০ সালে, তখন বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত আর হাজার হাজার মৃত্যুর কথা শুনে অনেকেই আতঙ্কিত হয়েছিল। এখন করোনার দ্বিতীয় কামড় শুরু হয়েছে। করোনার এই কামড়ে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত আর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি যেভাবে প্রতিকূল পরিলক্ষিত হচ্ছে তা দেখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলতে হচ্ছে আগামীতে কোটি কোটি মৃত্যুর খবর শুনতে হবে কি-না! বিষয়টি দুঃখজনক হলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী এভাবে বলতে হচ্ছে। কারণ এই মুহূর্তে বিশ্বে ১৬ কোটি মানুষ আক্রান্ত আর ৩১ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তারপরও এখনো আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সেই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। যদিও ইতোমধ্যে কয়েকটি ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। তারপরেও সাতশ কোটি মানুষকে শতভাগ টিকাদান সম্পন্ন করা, মিউটেশনের ফলে নিউ ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা ইত্যাদি প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ওই ভাবনা আসা অমূলক নয়।
সবাই জানেন, করোনা ভাইরাস শুরু হয়েছে ’১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে; কিন্তু প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কেউ জানে না এর শেষ পরিণতি কখন কোথায় হবে। আমাদের দেশে চলতি বছর মার্চ থেকে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ, যেটাকে আমি করোনার কামড় বলে অবহিত করছি। সাধারণত কোনো একটি দেশে বা অঞ্চলে সংক্রমণের হার নিম্নমুখী বা স্তিমিত হয়ে, পুনরায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তখন সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে ধরে নেয়া যায়। সেই হিসাবে আমরা বুঝতে পারছি, চলতি বছর মার্চ থেকে আমাদের দেশে দ্বিতীয় কামড় শুরু। অতীতের বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, সময়ের সাথে ভাইরাসের মিউটেশন হয়ে দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র বেলায় দ্বিতীয় সংক্রমণে এমন প্রমাণ মেলে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, মিউটেটেড ভাইরাস তুলনামূলকভাবে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে চলমান দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্রমণে দেখা যাচ্ছে, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাসের যে দ্বিতীয় সংক্রমণের সূচনা হয়েছিল, সেই একই ভ্যারিয়েন্ট এখানেও সংক্রমিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআর-বি; এই ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাস সংক্রমণের হার অত্যধিক এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশে আগের ভাইরাসটিও মিউটেশন হয়ে আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী হয়েছে বলে জানা যায়। যার ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। যদিও সংখ্যার হিসাবে কয়েকদিন থেকে কিছুটা কমে আসছে, কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে, আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে নিরাপদ বলা যাবে না। তাই আগামী সপ্তাহ দুয়েক পর করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ আরো ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি স্থিতিশীল না থেকে যা আরো খারাপের দিকে যায়, তখন কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বা ভয়ভীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যারা টিকা দিয়েছে তারা মনে করে, ‘করোনার টিকা তো দিয়েছি ভয় আর কী!’ আবার যারা একবার আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ধারণা একবার আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয় না। অন্যদিকে একশ্রেণির মানুষ মনে করে, ‘করোনাকে আমি ভয় পাই না, করোনা আমাকে ভয় পায়।’ এই কথা অনুমাননির্ভর হলেও তাদের আচরণ, চলাফেরা ও কথাবার্তায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তাদের নেই কোনো সচেতনতা, আছে শুধু অজ্ঞানতা। স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখেই অবাধে চলাফেরা করছে। যার ফলে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। আবারো লকডাউন দিতে হয়েছে; অন্যদিকে লকডাউন অমান্যতার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মানতে পারলে কঠোর লকডাউনের প্রয়োজন পড়ে না, যা পশ্চিমা অনেক দেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। তবে এটাও ঠিক, মানুষের জীবন-জীবিকা দুটিই প্রয়োজন রয়েছে। সব মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা সমান নয়। তাই জীবনের জন্যে ঘরে থাকতে হলেও জীবিকার তাগিদে অনেক মানুষকে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে। হয়তো দেখা যাবে দ্বিতীয় কামড়ের পরে তৃতীয় কামড় শুরু হবে। এভাবে কয়েক বছর আক্রমণের পর, করোনা ভাইরাস পর্যায়ক্রমে দুর্বল হয়ে হয়তো নির্মূল হবে। কিন্তু এই সময়টুকুতে আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে কিছু করণীয় প্রয়োজন। যেমন- সঠিক নিয়মে সকলে মাস্ক পরা, ৩ ফুট দূরত্বে অবস্থান করা, ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এগুলো পুরনো কথা হলেও নিয়মিত ও সঠিকভাবে সবাইকে পালন করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া আমাদের বেঁচে থাকার আপাতত অন্য কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।