ঢাকা : আজ আমাদের জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণ। আমরা অভ্রভেদী দাপট ও অহংকার নিয়ে পালন করছি যুগপৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠান এবং আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশ আজ সুবর্ণরেখায়। একদা ‘তলাবিহীন’ ঝুড়ি বলে যে দুষ্কৃতীরা আমাদের ললাটে কলঙ্কের ছাপ এঁকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সেই দেশকেই আজ জাতিসংঘ মধ্যম আয়ের দেশের শিরোপায় সুশোভিত করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রূপকল্প-২১ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ জাতির সামনে মহান সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেছে। আজ জল ও স্থল পেরিয়ে বাংলাদেশ আকাশও অধিকার করেছে, যেখানে সগর্বে বিরাজ করছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। আমাদের এই অভাবনীয় বৈপ্লবিক উন্নয়নের পেছনে রয়েছে জাতির নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগ। আজকের এই অহংকারভেজা দিনে তার প্রতি কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। ১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। বাতাসে তখনো লাশের গন্ধ। থামেনি স্বজনহারা মানুষের কান্নার রোল। যেদিকেই তাকানো যায় , সেদিকেই দগদগে ঘায়ের মতো ধ্বংসের চিহ্ন। দেশের অর্থনীতিকে শেষ করে গেছে হানাদার বাহিনী। এমনকি বাংলাদেশের জাহাজগুলো পর্যন্ত পাকবাহিনী ডুবিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সে সময়ে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি ভাষণেই যুদ্ববিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্র পাওয়া যায়।
বাহাত্ত্তর সালের ১০ মে পাবনায় আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি যেদিন সরকার নিই এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রা আমার কাছে ছিলো না। জাহাজ নাই, পোর্ট ভেঙ্গে দিয়েছে। মানুষকে আমি বলেছি, আমার দুঃখী মানুষকে বাঁচাও।... চট্টগ্রাম পোর্টে জাহাজ ডুবেছিলো। জাহাজ কোথায় পাবো! রেললাইন ভেঙ্গে দিয়েছিলো, রেললাইন চলে না। রেললাইন মেরামত করতে হবে। রাস্তার পুল ভেঙ্গে দিয়ে গিয়েছিলো। ট্রাক ছিলো না, ভিক্ষা করে ট্রাক এনে একেক জেলায় দিতে হয়েছে।’
বাস্তবিক অর্থেই নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছিল। সেই কঠিন সময়ে, ১৯৭২ সালের জুন মাসে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে বাজেট দিলেন, তার আয়তন ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। সেই জায়গা থেকে আজ পঞ্চাশ বছর পর বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তা ভাবলে মুগ্ধ বিস্ময় লুকিয়ে রাখা যায় না।
বাহাত্তর সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন সোনার বাংলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল, জাতির পিতা বহুদিন রাতে ঘুমোতে পারেননি। নির্ঘুম রাতে তিনি বত্রিশ নম্বরের বারান্দায় পাইপ হাতে পায়চারি করতেন। একথা তিনি তার জনগণের কাছে বলেছেন অকপটে নিজের বক্তৃতায়। তখন কোষাগারে রিজার্ভ বলতে ছিল না। তারপরও বঙ্গবন্ধুর বুকভরা স্বপ্ন ছিল। দেশের সাধারণ মানুষ তথা কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্র-জনতার ওপর তার ভরসা ছিল অপরিসীম। পাশে ছিল ভারত প্রজাতন্ত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল বিশ্ব। বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি—হেনরি কিসিঞ্জারের এই ধরনের নিকৃষ্ট উপহাসের উচিত জবাব দেওয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা এবং দেশের মানুষকে তৈরি করছিলেন ঘুরে দাঁড়াবার মতো করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের অভিশপ্ত ১৫ আগস্ট কালরাতে একদল বিশ্বাসঘাতক জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে কালিমা লেপ্টে দেয় সভ্যতার ললাটে। বাঙালির আর্থসামাজিক মুক্তির সকল প্রচেষ্টা যেন ভেসে যায় ১৫ আগস্টের রক্তস্রোতে। আর বাংলাদেশ পথ হারাল জিয়া-মুশতাকের সৃষ্ট কালের কৃষ্ণগহ্বরে। কিন্তু এটাই ইতিহাসের শেষ কথা নয়। সেই ব্ল্যাকহোলের পরিব্যাপ্তি ছিল টানা একুশ বছর। একুশ বছর পর তিমির দুয়ারে হানি আঘাত এলো নতুন প্রভাত। বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরে পেল জনগণের রায়ে। গঠিত হলো জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। এই আলো দীর্ঘস্থায়ী না হলেও অমানিশাকালে সৃষ্ট দগদগে ঘা সারিয়ে তুলবার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। এই জঘন্য ইনডেমনটি অধ্যাদেশ বলে বিশ্বাসঘাতক মোশতাক পনেরো আগস্ট পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
এই কালো আইন বাতিলের ঘটনাটি ছিল নতুন আলোর পথে শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম পদক্ষেপ। অতঃপর অচিরাৎ শুরু হয় পঁচাত্তরের হিংস্র ঘাতকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বত্রিশ নম্বর বাড়ির রিসেপশনিস্ট কাম বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন। তিন মাসাধিককাল তদন্ত করে সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করেন। খন্দকার মোশতাকসহ চারজন আগেই মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ঐতিহাসিক এই মামলায় ২০২ কার্যদিবসে মোট ৬১ জনের সাক্ষ্য ও অন্যান্য প্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিচারক ৮ নভেম্বর ১৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করেন। তিনজনকে বেকসুর খালাস দেন। আসামিরা নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপলি করলে হাইকোর্টের দ্বৈতবেঞ্চ ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিভক্ত রায় প্রদান করে। নিয়ম অনুযায়ী গঠন করা হয় তৃতীয় বেঞ্চ। এরই মধ্যে আবারো নতুন করে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী জামায়াত-শিবির ও বিএনপি চক্রের ষড়যন্ত্র। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য এরা লিপ্ত হয় ঘৃণ্য চক্রান্তে। লতিফুর রহমানের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে গদি দখল করে বিএনপি-জামায়াত জোট। ফলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের বিষয়টি ঝুলে পড়ে।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা সম্ভবপর না হলেও শান্তি ও অগ্রসরতার যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল তা আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল মাইলস্টোনস্বরূপ। এর আগে টানা একুশ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে চলেছে রক্তের হোলিখেলা। পার্বত্য স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শান্তিবাহিনী লিপ্ত হয় রক্তক্ষয়ী সংঘাতে। রক্তপাতের এই একুশ বছরে কত যে নিরীহ নারী ও পুরুষের প্রাণহানি ঘটেছে তার কোনো লেখাজোখা নেই। পঁচাত্তর-পরবর্তী একুশ বছর এই সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জিয়াউর রহমান এমন অপকৌশল গ্রহণ করে, যা ছিল গণবিরোধী ও আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার নামান্তর।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। সেই শান্তিচুক্তির ফলে পরের বছর ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্রোহী জনসংহতি সমিতির দুই সহস্রাধিক সদস্য অস্ত্রসমর্পণ করে। এদের প্রত্যেককেই পুলিশ ও আনসারসহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। ওই বছর জুলাই মাসে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ছাড়াও তিনটি জেলা পরিষদ সক্রিয় রয়েছে। মোটকথা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ এখন নিজেদের ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ও জীবনমান উন্নয়নের অবাধ সুযোগ পাচ্ছেন, যা এই চুক্তির আগে ছিল প্রায় অকল্পনীয়। এই ঐতিহাসিক চুক্তির বেশিরভাগ শর্তই ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির আগে পাহাড়ের জনজীবনে কী মৃত্যুভয়াল পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল, সেই সময়ের পত্রিকার পাতা খুললেই তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া যাবে।
এর অগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিরাজমান ফারাক্কা বাঁধের কারণে সৃষ্ট গঙ্গার পানি সমস্যার সমাধান করা হয় ঐতিহাসিক পানিবণ্টন চুক্তির মাধ্যমে। বন্ধুপ্রতিম দুটো রাষ্ট্র—বাংলাদেশ ও ভারতের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে একটি বিব্রতকর ইস্যু হিসেবে বিরাজমান ছিল এই গঙ্গার পানি। বাংলাদেশের প্রধান নদী প্রবাহের উজানে পাকিস্তান আমলে ইসলামাবাদের সাথে এক ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে উত্তর ভারতের বিভিন্ন চ্যানেলে পানি ডাইভার্ট করে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ নিপতিত হয় ভয়াবহ পানিসংকটে। পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এই তিনটি নদী শুকিয়ে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলে শুরু হয় মরূকরণ প্রক্রিয়া। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছিল দ্রুত। দেশের উত্তরাঞ্চলে দেখা দেয় খাবার পানির তীব্র সংকট। একইসাথে দেখ দেয় সেচ সংকট। অকেজো হয়ে পড়ে গভীর ও অগভীর নলকূপগুলো। স্বাধীনত-উত্তর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা বলে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রো-পাকিস্তান খুনি স্বৈরাচারী সরকার নিজেদের ক্ষমতা পোক্ত করার স্বার্থে ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশটির সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার চর্চা করেনি। সুদীর্ঘ ২১ বছর ধরে গঙ্গার পানিবণ্টন প্রশ্নে আলোচনার নামে চলেছে প্রহসন। এমন হাস্যকর ঘটনাও ঘটেছে, ভারত ঘুরে এসে তৎকলীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গঙ্গার পানিবণ্টনের কথা আমার মনে ছিল না। পানি প্রশ্নে স্বৈরাচারকবলিত বাংলাদেশের এহেন নির্বিকার অবস্থানের কারণে ওই সময়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিক বৈদেশিক চুক্তি ও আলোচনা হলেও জীবন-মরণ সমস্যা পানির কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা হয়নি।
এই পটভূমিতে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নতুন দিল্লিতে ভারতের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সামগ্রিক বৈদেশিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ন্যূনতম পানি সরবরাহের গ্যারান্টিসহ ৩০ বছরের পানিবণ্টনের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়।
গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বলেই ভিশন-২০২১-এর আলোকে ডেল্টাপ্ল্যান ২০১৮ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সহজ সম্ভব হয়ে উঠেছে। নেদারল্যান্ডসের মতো করে গ্রহণ করা শতবর্ষী ডেল্টাপ্ল্যান বাংলায় ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনাকে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি মনে করা হয়ে থাকে। নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যানিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ এই পরিকল্পনার অনুমোদন দেয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’। পরিকল্পনামন্ত্রীকে ডেল্টা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। এই পরিকল্পনার সুফল বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে।
এরই মধ্যে আমাদের অভিলক্ষ্যবর্ষ তথা ভিশন-২০২১ শেষ হতে চলল। পাশাপাশি আমরা এবার উদ্যাপন করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিবশতবর্ষ। বলা নিষ্প্রয়োজন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ভিশন ’২১-এরই অংশ। আরো সহজভাবে বলা যায়, ভিশন ’২১ অর্জনের পথে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা একটি অপরিহার্য কৌশলপত্র। এই কৌশলপত্র অনুযায়ী দেশজুড়ে নদী খনন ও ভাঙন প্রতিরোধী বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেচ ও খাবার পানির প্রাপ্যতা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বন্যার প্রকোপ ও নদীভাঙনের সমস্যা কমে এসেছে বহুলাংশে। দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে দারিদ্র্য পরিস্থিতির যে উন্নতি ঘটেছে তা কোনো চক্ষুষ্মানের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার কথা নয়।
২০০১ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ছিল দরিদ্র। সেটা ২০১০ থেকে ১৯ সালের মধ্যে নেমে এসেছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। ২০০৭ সালে যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৮৬ মার্কিন ডলার, সেটা এখন বেড়ে হয়েছে কমবেশি ২৪০০ মার্কিন ডলার। ২০০৯ থেকে ২০২১—বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের এই এক যুগকে পর্যবেক্ষকমহল নির্দ্বিধায় উন্নয়নের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করতে পারে।
বস্তুত এই বারো বছরে আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সেক্টরে বাংলাদেশ অর্জন করে অভূতপূর্ব সাফল্য। স্পর্শ করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ, কৃষি শিল্প, জনশক্তির উন্নয়ন ও বিকাশ—ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সেইসাথে লেগেছে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার মেগাওয়াট, যা লক্ষ্যমাত্রার চাইতেও বেশি। বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বণ্টন ব্যবস্থায় এখনো কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। হারিকেন-কুপিবাতির দিন ফুরিয়ে গেল বলে। দেশব্যাপী সড়ক যোগাযোগের যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্রাম থেকে উপজেলা সদর, উপজেলা থেকে জেলা এবং জেলা থেকে বিভাগীয় সদর ও রাজধানীতে সড়কপথে যাতায়ত এখন সহজ সম্ভব। বিস্তৃত সড়ক ও মহাসড়কের অব্যাহত সম্প্রসারণের সাথে একের পর এক যুক্ত হচ্ছে সর্বাধুনিক উন্নয়ন চিন্তা। রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন জনাকীর্ণ এলাকায় যানজট নিরসনকল্পে নির্মিত হয়েছে বহুসংখ্যক উড়ালসড়ক। নির্মাণাধীন রয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। হযরত শাহ জালাল (রহ.) বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবপুর পর্যন্ত ৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড সড়কের পাশাপাশি নির্মিত হচ্ছে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট। অন্যদিকে সমাপ্তির পথে উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মেট্রোরেল প্রকল্প। আশা করা যায়, বছরখানেকের মধ্যেই এই তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন হবে। এগুলো হয়ে গেলে ঢাকা-গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সূচিত হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। অন্যদিকে মহলবিশেষের সব চক্রান্ত ভণ্ডুল করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রাভিযানের চিত্রটি আরো স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতুসহ ১০টি মেগা প্রকল্প ও একশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিষয়ে এখানে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয়। জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে এই দশ মেগা প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন তথ্যাভিজ্ঞমহল। জনবান্ধব এই সরকারের আলোচিত এবং উচ্চতর উন্নয়ন অভিলাষী দশটি মেগা প্রকল্প হচ্ছে-পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লা ভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
এই দশ মেগা প্রকল্প ছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ৩০ হাজার হেক্টর জমি নিয়ে মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলছে। ২০১০ সালে ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন’ প্রণয়নের মাধ্যমে এ কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো (ইপিজেড) তৈরি হলে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি আয় সম্ভব হবে। একইসঙ্গে এই ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশের এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
গত এক যুগে শিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অর্জিত হয়েছে অকল্পনীয অগ্রসরতা। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন নিঃসন্দেহে রোল মডেলের দাবি করতে পারে। শিল্পকারখনার প্রসারের সাথে সাথে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রসার ঘটে চলেছে রপ্তানিমুখী ছোট-বড় শিল্পের । উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতায়ন, শিক্ষা প্রসার, সর্বোপরি ডিজিটালাইজেশানের ফলে মানুষের আয়-রোজগার বেড়ে গেছে বহুগুণে। তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করছে এখন দেশের অতি সাধারণ মানুষটিও। ডেস্কটপ, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনের মতো ডিভাইসগুলোর ব্যবহার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে স্থাপিত হয়েছে তথ্যসেবা কেন্দ্র। সাধারণ মানুষ জন্মনিবন্ধন ও জমির পরচা বের করার মতো বিবিধ তথ্যসেবা খুব সহজেই পাচ্ছেন এসব কেন্দ্র থেকে। প্রতি দুই কিলোমিটার অন্তর একটি করে তথ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
অন্যদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের খবর কমবেশি সবাই জানেন। স্কুল পর্যায়ে নির্মিত হয়েছে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ। এবারের করোনা অতিমারির মধ্যে বন্ধের সময়ে স্কুলগুলোতে চালু ছিল অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম। উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রেও এখন অনলাইন কার্যক্রম লাভ করেছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। মোবাইল ফোনের ব্যবহার যেমন ব্যাপকতা লাভ করেছে, তেমনই ধাপে ধাপে বাড়ছে এর গতি। সম্প্রতি দেশে চালু হয়েছে ফাইভ-জি মোবাইল নেটওয়ার্ক।
গত বারো বছরে বাংলাদেশ কৃষি ক্ষেত্রে অর্জন করেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। বর্তমানে পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। কাঁচা পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের স্থান প্রথম। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীর্য়। বিশ্বের ইলিশ উৎপাদনকারী এগারোটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন প্রথম। সামগ্রিকভাবে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
শহরের প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা এখন পৌঁছে গেছে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায়। একই সাথে বেড়েছে লোকের কর্মদক্ষতা ও কর্মস্পৃহা। বৈদেশিক কর্মসংস্থানও ক্রমবর্ধমান। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সামগ্রিক অগ্রসরতার অভঘাত; সে তো অবধারিত। বিশ্বসমাজের বিচারে বাংলাদেশ এখন আর দরিদ্র নয়। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করেছে ইতোমধ্যে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এক্ষণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর প্রায় অর্ধেক আসছে বিদেশে কর্মরত জনশক্তির পাঠানো রেমিট্যান্স আকারে।
জাতি আজ সগৌরবে উদ্যাপন করছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এই ডিসেম্বর গেলে আমাদের সামনে আসবে নতুন বছর, নতুন অভিলক্ষ্য—ভিশন-২০৪১ । সোনার বাংলার পঞ্চাশবর্ষে এসে একাত্তরের বীর বাঙালি আজ জেগে উঠেছে সন্তোষ আর নতুন প্রত্যাশার স্পন্দনে। বিগত অর্ধশত বছর ধরে বিবিধ ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন এবং নানান দোলাচলের মধ্য দিয়ে অবশেষে মানবতার জননী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পৌঁছেছে নতুন এক উচ্চতায়। বাংলার মানুষ আজ অনায়াসে বুকভরে টেনে নিতে পারেন মুঠো মুঠো স্নিগ্ধ বাতাস। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এখন আর স্বপ্ন নয়, ধরা দিয়েছে আজ বাস্তব হয়ে।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।