ঢাকা : মূলধারায় রিপোর্টিং ট্রেন্ড নিয়ে আলাপে এক চিফ রিপোর্টার বললেন, ভালো রিপোর্ট করলে যে বিজ্ঞাপন আসে, খারাপ করলে তা কিন্তু কমে না। বিজ্ঞাপনই যেহেতু পত্রিকার প্রাণ তাই ব্যয় কমিয়ে লাভ বাড়াতে কমদামের রিপোর্টারই নিতে চায় বেশিরভাগ হাউজ। তাছাড়া পত্রিকা জনপ্রিয় করাটা ভালো খবরও নয়, বরং দুঃসংবাদ। কারণ দামি দামি রিপোর্ট জনপ্রিয় হলেই পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে পত্রিকা বেশি ছাপাতে গিয়ে অতিরিক্ত খরচ হয়।
আলাপে এটাও উঠে এলো, পত্রিকার বিজ্ঞাপন রেট বাড়ানোর সিস্টেমটা এতটাই অদ্ভুত যে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি এখানে কাজ করে না। ফলে ভালো সাংবাদিকতার সঙ্গে পত্রিকার জনপ্রিয়তার গভীর যে সম্পর্ক তা-ও অর্থহীন হয়ে পড়ে। এমনকি অজনপ্রিয়, প্রচার সংখ্যায় তলানীতে থাকা পত্রিকাও শীর্ষ রেট পেয়ে লাভজনক হচ্ছে। ফলে ভালো সাংবাদিকতার অর্থ বা সংজ্ঞার বদল ঘটেছে।
পরিস্থিতি বুঝে পেশায় টিকে থাকার জন্য তাই ভালো তকমা থেকে বেরিয়ে আসছেন বহু সাংবাদিক। তারা হয় ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে নিজেকে দারুণভাবে যুক্ত করছেন, নয়তো বিনিয়োগকারীদের আরও ঘনিষ্ট, বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করছেন। যে পদ্ধতি বা কৌশল চাকরি রক্ষার সহায়ক, সেদিকেই নজর রাখছেন বেশি বেশি। ফলে ভালো সাংবাদিকতা দিন দিন দুঃসাধ্য, দুর্লভ হয়ে উঠছে। অপোষ করতে না পারায় পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন কিংবা নীরব থাকছেন অনেক সাহসী সাংবাদিক।
পেশায় আসার আগে যেসব সাংবাদিক সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে অভিজ্ঞ ছিলেন তারা সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতা হতে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। রাজনৈতিক দল, অন্যান্য ক্ষমতা বা প্রভাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ফলে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতা হওয়ার তালিকা দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশেষত সাংবাদিকতায় পিছিয়ে থাকা অনেকেই নিজেদের ফোকাসে আনতে নেতা নির্বাচিত হওয়াকেই টার্গেট করছেন।
বিগত দেড় দুই দশক ধরে বিগ বাজাটের যেসব পত্রিকা লিড দিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা একেবারেই নাজুক হয়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ জটিলতা, অন্তর্কলহ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ইনহাউজ ব্যাড পলিটিক্স, তীব্র প্রতিযোগিতায় বিষাক্ত হয়ে উঠছে চাকরি ও কর্মপরিবেশ। সবচেয়ে ভালো, অভিজ্ঞ, দক্ষরা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধায় অনবরত পিছিয়ে পড়ছেন। বিপরীতে রহস্যজনক কারণে অদক্ষরা এগিয়ে যাচ্ছেন। বৈষম্যের ধকল সামলাতে সাংবাদিকদের মানসিক চাপ, পীড়ন বাড়ছে। অনেকেই উচ্চরক্তচাপের রোগী হয়ে যাচ্ছেন। আকস্মিক মৃত্যুও বাড়ছে।
এমনকি বরেণ্য অনেক দামি সম্পাদকও চরম বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ফাঁদে পড়ছেন। নিজেদের নির্মোহ চরিত্র ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন। পত্রিকায় যা লিখছেন কিংবা প্রচারমাধ্যমে যা বকছেন তার প্রতিফলন থাকছে না নিজের অফিসে কিংবা ব্যক্তিগত আচরণে। এছাড়া রাজনৈতিক বিভাজনে দারুণভাবে সক্রিয় থাকায় তাদের সম্পাদিত পত্রিকাই শুধু নয়, ব্যক্তিগত বক্তব্য কিংবা ভূমিকাও নির্মোহ কিনা তা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছেই। যার প্রভাব সব গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপরে গিয়ে পড়ছে।
লেখক : সাংবাদিক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।