ঢাকা: সহজ কথায় জীবন বীমা পলিসির প্রিমিয়াম পেমেন্ট মিস হয়ে গেলে পলিসি তামাদি হয়ে যায়। জীবন বীমার প্রচলিত আইনে ১টি প্রিমিয়াম জমার পর ৫ বছরের মধ্যে আর কোন প্রিমিয়াম জমা না দিলে ১ম জমাকৃত টাকা Lapse বা তামাদি হয়ে যাবে।
পলিসি তামাদি হওয়ার কারণ:
গ্রাহকের সামর্থ্যের চেয়ে বেশি টাকার বীমা পলিসি বিক্রি করাঃ গ্রাহকের সামর্থ্যের চেয়ে বেশী টাকার বীমা দিলে প্রথম বার প্রিমিয়াম জমা দিতে পারলেও ২য় ও ৩য় প্রিমিয়ামের টাকা দিতে পারবে কিনা কিংবা ২য় বা ৩য় বার পারলেও পরে আর চালাতে পারবে না। যে বীমা গ্রাহক বছরে ১০ হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিতে অক্ষম তাকে ২০ হাজার টাকা প্রিমিয়ামের পলিসি দিলে তামাদি হয়ে যায়।
সামর্থ্যের চেয়ে কম টাকার প্রিমিয়াম- কোন গ্রাহকের সামর্থ্যের চেয়ে কম টাকার বীমা পলিসি ব্রিক্রি করলে গ্রাহক মন খারাপ করে ঐ পলিসি নাও চালাতে পারে। এর ফলে পলিসি তামাদি হতে পারে।
গ্রাহকের আর্থিক বিপর্যয়- গ্রাহকের পরিবারের কারণে আর্থিক বিপর্যয় দেখা দেয়। যেমন ছেলে-মেয়ের বিবাহ, নতুন ব্যবসায় লোকসানের ফলে আর্থিক বিপর্যয় দেখা দেয়। এ সকল ক্ষেত্রে পলিসি বন্ধ হয়ে তামাদি হয়ে যেতে পারে।
চাপের মুখে বীমা করানো- অনেক সময় এজেন্ট জোর করে সম্ভাব্য গ্রাহকের কাছে বীমা পলিসি বিক্রি করে থাকে। পরবর্তীতে ঐ গ্রাহক আর পলিসির প্রিমিয়াম জমা না দেওয়ার কারণে পলিসি তামাদি হয়ে যায়।
সেবার অভাব- আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বীমা করার পর গ্রাহকের সাথে আর কোন যোগাযোগ দরকার নেই। দেখা গেছে ২৫% নতুন প্রিমিয়াম পুরাতন গ্রাহকদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সুতরাং গ্রাহককে সামান্য সেবা দেয়ার মাধ্যমে সখ্যতা ও আন্তরিকতা বজায় রাখা উচিত।
রেয়াত- অনেক সময় বীমা কর্মী তার নিজের কমিশন থেকে গ্রাহককে কিছু টাকা সুবিধা দিয়ে বা কম দেয়ার কথা বলতে পারে বা বলে থাকে যাকে রেয়াত বলা হয়। এটা কোনভাবেই কাম্য নয়, যা নিজের জন্য আত্মঘাতী ও বীমা শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
ধৈর্য্যরে অভাব- অনেক সময় দীর্ঘ মেয়াদী বীমায় ত্রৈমাসিক বা ষান্মাষিক প্রিমিয়াম দিতে দিতে এক সময় অধৈর্য্য হয়ে হয়তোবা প্রিমিয়াম দেয় না তখন পলিসিট তামাদি হয়ে যায়।
প্রিমিয়াম আত্মসাৎ- অনেক সময় গ্রাহক সরল বিশ্বাসে এজেন্টকে প্রিমিয়ামের টাকা দিয়ে থাকেন। সেই প্রিমিয়ামের টাকা আত্মসাৎ করে খরচ করে ফেলে। পরে যখন রশিদ দেয় বা দেয়ই না তখন হয়তো পলিসি তামাদি হয়ে যায়।
তামাদির প্রতিক্রিয়া বা ফলাফল:
ধারাবাহিকতায় ক্ষতিঃ সাধারণত জীবন বীমা একটি দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি অর্থাৎ একটি পলিসি ১৫,১৬ বা ১৭ বছর চলবে, এমনটি বীমা কোম্পানীর প্রত্যাশা থাকে। যদি অল্প সময়ে পলিসি তামাদি হয়ে যায়, তাহলে ব্যবসার ধারাবাহিকতায় ক্ষতি হবে।
প্রিমিয়াম আয়ে ক্ষতি- একটি জীবন বীমা পলিসি হতে দীর্ঘদিন প্রিমিয়াম পাবার কথা। এ ধরণের পলিসি যদি হঠাৎ তামাদি হয়ে যায়, তাহলে কোম্পানীর ভবিষ্যত প্রিমিয়াম আয়ের ধারাবাহিতকতার ক্ষতি হতে পারে।
ব্যবসার প্রসারে ক্ষতি- যদি কোন গ্রাহকের পলিসি তামাদি হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ জমাকৃত টাকা না পায় তাহলে সে অন্যদের বলে বেড়াবে যে বীমা ভাল নয়, বীমা করো না। এতে ব্যবসা প্রসারে বিঘ্ন ঘটবে।
প্রশাসনিক উচ্চ ব্যয়- দেখা যায়, প্রথম বছরে একটি বীমা পলিসি কমিশন ও প্রসাসনিক ব্যয় শতকরা ১০০% হয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানের সুনামের ক্ষতি- যখন একজন গ্রাহকের পলিসি তামাদি হয়ে যায় তখন ঐ গ্রাহক যেহেতু জমাকৃত টাকা ফেরৎ পায় না।
তামাদি প্রতিরোধের উপায়:
প্রধান কার্যালয়ের অবলিখন- একটি আবেদন বিবেচনা করার সময় প্রধান কার্যালয়ের অবলিখন বিভাগ যদি স্থায়িত্ব নিয়ে যাচাই বাছাই করে যে পলিসি তামাদি হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাহা নাকচ করতে হবে।
এজেন্সী স্তর- একজন এজেন্টকে বুঝতে হবে কোন পলিসি তামাদি হতে পারে, কারণ এজেন্ট ভাল জানে। সুতরাং এজেন্টকে আন্তরিকভাবে কোম্পানীর স্বার্থ দেখতে হবে এবং এ জন্য প্রশিক্ষণও দিতে হবে।
স্থায়ীত্বের পরিমাপক- আমাদের দেশে যদিও স্থায়ীত্বের পরিমাপক ব্যবহার করা হয়না তবু এর সুযোগ আছে। কোন ধরণের পলিসি কত দিন স্থায়ী হয় বা কত দিন পর তামাদি হয় তার একটি তালিকা তৈরী করা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া।
স্থায়ীত্ব বোনাস- যে এজেন্টের পলিসি বেশী স্থায়ী হবে অর্থাৎ তামাদি কম হবে, সে এজেন্টকে স্থায়ীত্ব বোনাস দিয়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
প্রধান কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ- প্রধান কার্যালয়ে একটি সেকশন করা যেতে পারে যারা তামাদি বিষয়ে সার্বক্ষণিক লক্ষ্য রাখবে।
প্রথম বর্ষ কমিশন- সাধারণত জীবন বীমায় প্রথম বর্ষ কমিশনের হার অত্যধিক বেশী। প্রথম বর্ষ কমিশনকে কিছু কমিয়ে অন্যান্য বছরেও কিছু বেশী দেওয়া যেতে পারে।
তামাদির পরিমাণ- যদি এজেন্টদের প্রতি বছরের তামাদির হিসাব দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা নেবে।
গ্রাহক সেবা- বীমা প্রতিষ্ঠান সমূহ সেবার মান উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে যেমন:-
ক. গ্রাহকদের সময়মত প্রিমিয়াম নোটিশ দেওয়া এবং নিশ্চিত করা। খ. এলাকাভিত্তিক গ্রাহক সমাবেশের মাধ্যমে দাবীর টাকা বা চেক দ্রুত প্রদান করা যেতে পারে যাতে অন্যান্য গ্রাহকরা তামাদি রোধে সচেতন হয়। গ. দেশে দুর্যোগ দেখা দিলে কোম্পানীসমূহ সমাজে গ্রাহকদের পাশে সহানুভূতির সাথে দাড়াতে পারে। ঘ. ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রিমিয়াম গ্রহণ করা সহ মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস যেমন-বিকাশ, রকেট, নগদ ও উপায়ের মাধ্যমে প্রিমিয়াম গ্রহণ করা যেতে পারে। ঙ. গ্রাহকদের তামাদির প্রতিক্রিয়া ও গ্রাহকরা কি কি ক্ষতির সম্মুখীণ হবে তা বুঝানো যেতে পারে ইত্যাদি।
এস এম নুরুজ্জামান
সিইও
জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড
ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী জেনারেল, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম।
ইমেইল: [email protected]
আইএ
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।