ঢাকা: হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে আরও কৌশলী নীতিতে এগোচ্ছে সরকার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে নেওয়া কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জ্বালাও-পোড়াওয়ের পর জড়িতদের গ্রেপ্তারে এরই মধ্যে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। যারা সরাসরি তাণ্ডবে জড়িয়েছে, তাদের প্রথমে আইনের আওতায় আনা হবে।
এরপর হামলার নির্দেশদাতাদের ধরা হবে। তবে হেফাজতের বিতর্কিত যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ইস্যুতে এখনও 'ধীরে চলো' নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে। 'সবুজ সংকেত' না পাওয়া পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তবে তিনি নজরদারিতে রয়েছেন। সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন দায়িত্বশীল পর্যায়ে কথা বলে হেফাজত নিয়ে এমন নীতি গ্রহণের আভাস মিলেছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত ইস্যু বলে আর নীরব থেকে মামুনুলকাণ্ড পার করতে চান হেফাজতের নেতারা।
এদিকে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে রোববার চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় জরুরি বৈঠক করে হেফাজত। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ৩৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা এতে যোগ দেন। বৈঠকে এক নেতা মামুনুল হকের বিয়ে ও রিসোর্টকাে র প্রসঙ্গ তুললে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে হেফাজত আমির জুনায়েদ বাবুনগরী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে রিসোর্টে যাওয়া মামুনুলের ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়নি। কাউকে অব্যাহতি দেওয়া নিয়েও কথা হয়নি।
হেফাজতের আমির আরও বলেন, হাটহাজারী, পটিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতি রাতে পুলিশ ও র্যাব নিরীহ মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে হয়রানি করছে। অনেককে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠাচ্ছে। তিনি সরকারের কাছে হয়রানি ও জুলুম-নির্যাতন বন্ধের জোর দাবি জানান। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার করোনার নামে লকডাউন দিয়ে মাদ্রাসা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। লকডাউন দিয়ে মাদ্রাসা বন্ধ করা যাবে না। নামাজ, জুমা, ইতেকাফ চলবে। মাদ্রাসা, হেফজখানা ও নুরানি মাদ্রাসায় হাদিস-কোরআন পাঠ করা হয়। যেখানে কোরআন-হাদিস পাঠ করা হয়, সেখানে করোনা আসবে না। আজ পর্যন্ত হাটহাজারী মাদ্রাসার কোনো ছাত্র ও শিক্ষক করোনা আক্রান্ত হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
বাবুনগরী বলেন, প্রশাসন মাদ্রাসায় কত ছাত্র লেখাপড়া করে, কমিটিতে কে কে আছে, মাদ্রাসার আয়ের উৎস কী- এসব জিজ্ঞাসা করে হয়রানি করছে। আমরা জানাতে চাই, কওমি মাদ্রাসা জনগণের টাকা দিয়ে চলে। কওমি মাদ্রাসা জনগণের মাদ্রাসা। পরিস্কারভাবে বলতে চাই, কওমি মাদ্রাসা চালানোর জন্য কখনও সরকারি কোনো অর্থ গ্রহণ করব না। তিনি আরও বলেন, হেফাজতের আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলন নয়। হেফাজতের আন্দোলন ইমান ও আকিদা রক্ষার আন্দোলন। সরকার ১০০ বছর নয়, প্রয়োজনে ২০০ বছর থাকুক, তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন হেফাজতের আমির। বৈঠক শেষে আগামী ২৯ মে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ সম্মেলন ঘোষণা করা হয়।
জানা গেছে, হাটহাজারী মাদ্রাসায় বৈঠকে হেফাজতে ইসলামের জ্যেষ্ঠ নেতারা প্রশ্ন তোলেন, ২৬ মার্চ তাদের কোনো কর্মসূচি না থাকলেও সেদিন জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে কারা মোদিবিরোধী মিছিল করেছিল? তাতে পুলিশের উপস্থিতিতে কীভাবে হামলা ও সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছিল? এর প্রতিক্রিয়ায় নেতাদের অগোচরে হেফাজতের কেন্দ্রস্থল হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে কার সিদ্ধান্তে মিছিল করে থানার দিকে যাওয়া হয়েছিল? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী।
তিনি জানান, সেদিন মাদ্রাসা থেকে দূরে ছিলেন। মিছিলের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। রোববারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুল আউয়াল, যুগ্ম মহাসচিব জোনায়েদ আল-হাবিব, নাছির উদ্দিন মুনীর, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসেন রাজী, খোরশেদ আলম কাসেমী, প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজি, কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক মুনির কাসেমী প্রমুখ।
এদিকে, হেফাজতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঝুঁকিমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যেসব এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম কিছুটা দুর্বল, সেসব এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সেসব এলাকার সাংগঠনিক দুর্বলতার দিকগুলোর পাশাপাশি ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ সিলেট ও চট্টগ্রাম, ডা. দীপু মনি ঢাকা ও ময়মনসিংহ, ড. হাছান মাহমুদ রংপুর ও রাজশাহী, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আওতাধীন জেলা ও উপজেলার সাংগঠনিক কার্যক্রমের খুঁটিনাটি নিবিড়ভাবে পরখ করে দেখছেন। এই চার নেতাকে সহায়তা করছেন আটজন সাংগঠনিক সম্পাদক।
তাদের মধ্যে সিলেটে আহমদ হোসেন, খুলনায় বি এম মোজাম্মেল হক, চট্টগ্রামে আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, রাজশাহীতে এস এম কামাল হোসেন, ঢাকায় মির্জা আজম, বরিশালে অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, ময়মনসিংহে সফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এবং রংপুরে সাখাওয়াত হোসেন শফিক তৃণমূল পর্যায়ে চলমান সাংগঠনিক কার্যক্রমের খোঁজখবর নিচ্ছেন; তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।
এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে মাহবুবউল-আলম হানিফের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। তিনি জানিয়েছেন, সব অপশক্তির বিষয়ে জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রথমেই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংগঠনের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে দলকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে।
সাখাওয়াত হোসেন শফিক রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক হালচাল নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে কথা বলেছেন। একই সঙ্গে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সাখাওয়াত হোসেন শফিক বলেছেন, হেফাজত ইস্যুতে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কওমি মাদ্রাসাগুলোর দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িত হেফাজত কর্মীদের তালিকা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা বলছেন, হেফাজতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে দলের অনেক নেতাকর্মী মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এইচএন
আপনার মতামত লিখুন :