• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে হেফাজত নেতারা


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ১৫, ২০২১, ১২:৪১ পিএম
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে হেফাজত নেতারা

ঢাকা : সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে ইসলামের সহিংসতার ঘটনায় সংগঠনটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন। নেতাদের গ্রেপ্তার আর সংগঠনের সহিংসতা বন্ধে কঠোর নজরদারি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ জন্য পুরনো মামলা সচল এবং সাম্প্রতিক বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় মামলা-গ্রেপ্তারে বহুমুখী চাপে পড়েছে হেফাজতে ইসলাম।

গুঞ্জন আছে, হেফাজতে ইসলামের আলোচিত-সমালোচিত কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক গ্রেপ্তার হতে পারেন যেকোনো সময়।

হেফাজতে ইসলামের নেতারা দাবি করছেন, সরকার তাদের বিপদে ফেলতে ও আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে একের পর এক মামলা আর নেতাদের গ্রেপ্তার করছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে সরকারকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তারা বলছে, এ নিয়ে তারা শিগগির বসে কর্মসূচি জানাবে।

এদিকে, হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। সাত বছর আগে রাজধানীর মতিঝিলে জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে। তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পিবিআই। প্রতিবেদনে হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনের নাম রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জে একটি রিসোর্টে মামুনুল-কাণ্ড সেখানে ভাঙচুরের অভিযোগ করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে হেফাজতের নেতা মাওলানা ইকবাল, মাওলানা মহিউদ্দীন, মাওলানা শাহজাহান শিবলী ও মাওলানা মোয়াজ্জেমকে। দুই মামলায় এই চারজনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্যের জেরে ময়মনসিংহে ওয়াসিক বিল্লাহ নোমানীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আর হেফাজতের পক্ষে সোচ্চার থাকা কথিত ‘শিশুবক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানী গ্রেপ্তারের পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় এখন কারাগারে।

এসব মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। পুলিশ বলছে, নতুন ও পুরনো মিলিয়ে প্রায় ১৬০ মামলায় হেফাজতের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী আসামি হয়েছে।

গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমে আন্দোলন ও সহিংসতার ঘটনায় হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। রাজধানীর কয়েকটি স্থানসহ দেশের চারটি জেলায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অস্ত্র লুটসহ নাশকতার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের প্রায় ৫০ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ৮০টি মামলা করা হয়েছে।

পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ বাদী হয়ে দায়ের করা এসব মামলায় হেফাজতের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও সাধারণ কর্মীরা আসামি হয়েছে। যার মধ্যে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। আসামির তালিকায় মদতদাতা হিসেবে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামও রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, হেফাজতে ইসলামকে আর ছাড় দেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে হবে। হেফাজতের নাশকতা, নারী কেলেঙ্কারি এসবের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় জনমত গঠন করতে হবে। নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ দাবি করছে, মামলার আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে। একাধিক মামলার আসামি হেফাজতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ধরতে সরকারের সবুজ সংকেত পেয়েছে পুলিশ।

এ ছাড়া ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর-কাণ্ডে হেফাজত নেতা-কর্মীদের নামে দায়েরকৃত ৮৩টি পুরনো মামলার তদন্ত শেষ করে বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। এসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়।

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দায়েরকৃত ৪৮টি মামলায় হেফাজতের ৩০ হাজার নেতা-কর্মী আসামি। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় ৬টি, নারায়ণগঞ্জ জেলার তিন থানায় ১৬ মামলা, ঢাকার পল্টন থানার দুটি ও মতিঝিল থানার দুই মামলায় আসামি প্রায় ২০ হাজার।

মামুনুল হকের সোনারগাঁও রিসোর্ট কাণ্ডের পর সেখানে হামলা চালায় সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। রিসোর্টে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ছাড়াও শীর্ষ এই নেতার (মামুনুল) বিরুদ্ধে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অন্তত চারটি মামলা হয়েছে। এর আগে তার বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফায়েজি বলেন, ‘আজ (সোমবার) আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছিল।

এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদিকে আটক করা হয়েছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। তা ছাড়া নারায়ণগঞ্জের চারজন নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। হেফাজতের দায়িত্বশীল ওয়াসিক বিল্লাহ নোমানীকে রোববার ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই দিন নারায়ণগঞ্জে আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রচার সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফায়েজি বলেন, ‘আমরা মনে করছি এগুলো হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার। আমাদের যে আন্দোলন চলছিল, সেটা দমন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে চাপে রাখা হচ্ছে। সেই চেষ্টাই সরকার চালাচ্ছে। না হলে অনেক পুরনো মামলা তারা নতুন করে কেন সচল করছে। যেগুলো সবই হয়রানির উদ্দেশ্যে আর আন্দোলন বন্ধ করার জন্য হচ্ছে।’

দ্রুতই বসে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়ে সংগঠনটির এই নেতা বলেন, ‘আমরা রোববার মিটিং শেষেও আহ্বান জানিয়েছি, যারা কারাবন্দি হয়েছে তাদের দ্রুত মুক্তি দিতে হবে। আর হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে, সেগুলো বাতিল করতে হবে। কিন্তু এসব দাবি সরকার শুনছে না। বরং অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে।’

অপরদিকে ‘শিশু বক্তা’ হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গাজীপুরে তার মাদরাসাটিতেও তালা ঝুলছে। মাদানীকে গত বুধবার নেত্রকোনায় তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার তাকে গাজীপুরের গাছা থানায় হস্তান্তর করে র্যাব। গত ১০ ফেব্রুয়ারি এক ওয়াজ মাহফিলে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।

তার এই উসকানিমূলক বক্তব্যের ফলে ২৬ মার্চ ঢাকায় বায়তুল মোকাররম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতা ও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সংগঠিত হয়- দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

যত অভিযোগ : গত বছরের ডিসেম্বরে আল্লামা শফীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগে ৩৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন তার শ্যালক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন। আদালত মামলা আমলে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই মামলায় সংগঠনটির বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই। গতকাল চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (৩)-এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

নারায়ণগঞ্জে বিএনপিদলীয় কাউন্সিলর ইকবাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুরকারী আরমান মালিক ও ঘোড়া নিয়ে হামলায় জড়ানো যুবক সৈকত হোসেনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্যের জেরে ইসলামিক বক্তা ও সমাজসেবী সংগঠন খাইরুল উম্মাহর ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ওয়াসিক বিল্লাহ নোমানীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।  রোববার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ যা বলছে : চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম রশিদুল বলেন, সহিংসতায় জড়িতদের আটকে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কারো ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান জানান, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার মামলার অনেক আসামি আটক হয়েছে। অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে। তাদের ব্যাপারে পুলিশের নীতি জিরো টলারেন্স।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বলেছেন, সোনারগাঁও, সিদ্ধিরগঞ্জ ও রূপগঞ্জ থানায় হেফাজত নেতা-কর্মীদের নামে এ পর্যন্ত ১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ চেষ্টা করছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

Wordbridge School
Link copied!