• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

নাগরিক ঐক্যের ‘কল্যাণরাষ্ট্র ভাবনা’ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ২৯, ২০২১, ০২:৪৪ পিএম
নাগরিক ঐক্যের ‘কল্যাণরাষ্ট্র ভাবনা’ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

ছবি : আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

ঢাকা : ‘প্রথম বছরেই দেশের সবচেয়ে দরিদ্র এবং কম সামর্থ্যবান ৬ কোটি মানুষকে মাসে মাথাপিছু ১০০০ টাকা করে দেয়া হবে। পরবর্তীতে এই কর্মসূচির আওতা এবং ক্রমান্বয়ে ভাতার পরিমাণও বাড়ানো হবে।’ বলে ঘোষণা দেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। 

সোমবার (২৯ নভেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘কল্যাণরাষ্ট্র ভাবনা’ আলোচনা সভায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে তাদের ভবিষ্যত রূপরেখা তুলে ধরতে তিনি এই ঘোষণা দেন।

আলোচনা সভায় মান্না বলেন, ‘দশ ভাগ লোক নব্বই ভাগ লোকের অর্থসম্পদ লুটপাট করে খাচ্ছে, এর নাম উন্নয়ন নয়। আমরা সামগ্রিক উন্নয়ন চাই, সেই আলোকে আমরা বাংলাদেশে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। নাগরিক ঐক্য ক্ষমতায় গেলে তা করবে। আমরা কাল ক্ষমতায় গেলে পরশুর বাজেটেই এই পরিকল্পনা আনবো। দুর্নীতি দূর করে এই বাজেট আমাদের হাতে থাকবে। আমরা তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেবো।’

এই বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা হবে। শুধু ডিগ্রি দেবার শিক্ষা নয়, দেশে/বিদেশে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার শিক্ষা দেয়া হবে। যাচ্ছেতাই পর্যায়ে চলে যাওয়া শিক্ষার মান উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি জ্ঞান নিশ্চিতে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এই সংক্রান্ত প্রাথমিক জ্ঞান দেয়া হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষায়িত বিভাগ চালু করা হবে।’

অন্য দিকে স্বাস্থ্য বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের পদক্ষেপ সম্পর্কে মান্না বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের পদক্ষেপ হবে জনমুখী। দেশের দারিদ্র্য সীমার নিচের সকল মানুষের সকল ওষুধসহ সব রকম চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। মধ্যবিত্তদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নেয়া চিকিৎসার পুরো খরচ দেবে রাষ্ট্র। এরপর দ্রুতই পর্যায়ক্রমে সবার জন্য সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের আয় তার জনগণের জন্য। এখানে সব মানুষের একটি ন্যূনতম আয় থাকবে। শুরুতে অধিকতর দরিদ্র, আয়হীন, নিম্ন আয়ের ৬ কোটি মানুষজন এটি পেলেও এটির পরিমাণ ১০০০ টাকা থেকে বাড়বে ও আমাদের সক্ষমতার সাথে বাড়বে এবং সবাই তা পাবে।’

কৃষি নিয়ে তিনি বলেন, ‘কৃষকের কৃষিপণ্যের ন্যয্যমূল্য নিশ্চিত করবো। ধান, গম, ডাল, আলু প্রভৃতি পর্যায়ক্রমে সরকারি তত্ত্বাবধানে সরাসরি কৃষকদের থেকে ক্রয় করে সারা দেশে সরবরাহ করার মাধ্যমে পণ্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। নগদ টাকার সংস্থানের জন্য কৃষকদের বিশেষ ক্রেডিট কার্ড দেয়া হবে। ভর্তুকি মূল্যে কৃষি সারঞ্জাম দেয়া হবে। প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো দুর্যোগে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে কৃষিঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করা হবে।’ 

বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান আলোচনায় মান্নান বলেন, ‘নতুন উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে, স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার জন্য প্রতি বছরের বাজেটে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হবে। স্নাতক/স্নাতকোত্তর পাশ বেকারদের ন্যূনতম বেকার ভাতার আওতায় আনা হবে। রাষ্ট্রে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা-পরিবেশ তৈরি করার সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে যা অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। বিদেশে যাওয়া সব কর্মীর কাজ এবং ভাষার প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হবে। ফ্রিল্যান্সিং করার উপযোগী দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের জন্য ঋণ দেয়া হবে। ফ্রিল্যান্সিং এর আয় দেশে আনার ব্যবস্থা করা হবে। এই আয় হবে করমুক্ত। বেকারদের স্বকর্ম সংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যাপ্তি অনেক বাড়ানো হবে।’

‘দুর্নীতি দমনে কঠোর অবস্থান প্রকাশ করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে। মেগা প্রকল্প, ব্যাংক ঋণ, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, শেয়ার বাজারে যে লুটপাট হয়েছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেগুলোর বিচার করা হবে। অতীতে দুর্নীতির সাথে জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে ভবিষ্যতের দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে বলেন তিনি।’

অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ঘোষিত প্রতিটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। অপ্রয়োজনীয়, অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক প্রকল্প বাতিল করা হবে। লক্ষ্য থাকবে, দেশ যেন কোনোভাবেই ঋণ-ফাঁদে না পড়ে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক প্রকল্পের জন্য প্রতিযোগিতামূলক ঋণপ্রাপ্তির চেষ্টা করা হবে। বর্তমানে চলমান প্রকল্পের ব্যয় দর কষাকষির মাধ্যমে কমিয়ে আনা হবে।’

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন করার কথা রয়েছে নাগরিক ঐক্যের কল্যাণরাষ্ট্র ভাবনায়। মান্না বলেন, ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের সাথে জড়িতদের বিচার করে কঠোরতম শাস্তি দেয়া হবে। আর একটিও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড/গুম হতে দেয়া হবে না। পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক ইন্ধনে ব্যবহার বন্ধ করে সত্যিকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীতে পরিণত করা হবে যেন তারা জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানে মনোযোগী থাকতে পারে। প্রশাসন এবং আইনশঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতি বন্ধ করে তাদের দক্ষ, জনবান্ধব করে গড়ে তুলে অপরাধ দমন করা হবে।’

বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীন করবে নাগরিক ঐক্য সরকার। তিনি বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবেই সরকারের কর্তৃত্ব থাকা (অনুচ্ছেদ ১১৫, ১১৬) নিম্ন-আদালতকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে শুধুমাত্র উচ্চ আদালতের কর্তৃত্বাধীন করা হবে।
 
• বিচার বিভাগের জন্য বিচার বিভাগের পূর্ণ কর্তৃত্বাধীন পৃথক সচিবালয় স্থাপিত হবে। 

• মামলা-জট কমানোর জন্য পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানোসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হবে।

• মিথ্যা, হয়রানিমূলক মামলার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’ 

স্থানীয় সরকার নিয়ে মান্না বলেন, ‘এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিকেন্দ্রীকরণ এর জন্য স্থানীয় সরকারকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করা হবে। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী (অনুচ্ছেদ ৫৯, ৬০) চেক এন্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের হাতে প্রশাসন ও সরকারী কর্মচারীদের কাজ, জনশৃংখলা রক্ষা, জনসাধারণের কাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন-বাস্তবায়ন, কর আরোপ করার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করা হবে।’

এতো কল্যাণমূলক ভাবনা বাস্তবায়নের টাকা কোথা থেকে আসবে? এই প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকারের নেয়া প্রতিটি কল্যাণমূলক পদক্ষেপ সফল হবার জন্য অত্যাবশ্যক শর্ত হচ্ছে দুর্নীতি দমন এবং সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রশাসনিক সংস্কার করা। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও সেটা ছাড়া কোনো কাজ সফল হবে না। তাই ক্ষমতায় গেলে আমাদের প্রথম কাজ হবে দ্রুত সেটা নিশ্চিত করা। লুটপাট-পাচার নিয়ন্ত্রণ, কর ফাঁকি কমানো, অভ্যন্তরীণ আহরণ যথাযথ করতে পারলে প্রায় ১ থেকে ২ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব বাড়ানো যাবে বলে আমাদের ধারণা। এবং তাতে আমাদের প্রাথমিক সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হবে। 

কল্যাণরাষ্ট্র ভাবনা আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট এর আইনজীবী ব্যারিস্টার আনোয়ার বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের কাছে নিগুড়ভাবে দেশ-মানুষের কল্যাণ-ভাবনা নিয়ে কথা বলা দেখতে পেলাম সম্ভবত বিশ বছরে এটিই। নাগরিক ঐক্য যা উল্লেখ করেছে, যেভাবে বলেছে তা একদিনেই না হোক, সদিচ্ছায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পরিবেশের বর্তমান অবস্থায় অধিক ক্ষতিগ্রস্ততার শঙ্কায় থাকা মানুষজনের কথা, তাদের সহায়তায় আমাদের প্রস্তুতি আরও বিস্তারিত বলতে হবে। কল্যাণরাষ্ট্র ভাবনা ও তার বাস্তবায়ন প্রচেষ্টায় নাগরিক ঐক্যকে স্বাগতম। স্বাস্থ, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে চমৎকার পরিকল্পনা বলেছে নাগরিক ঐক্য। এরপর আরও বিশ্লেষণ ও বিস্তৃত করে তা প্রকাশ করতে আহ্বান জানাই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন ব্যাপারী তার বক্তব্যে রাজনীতির প্রাচীন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা, বর্তমানে মানুষের জন্য কল্যাণভাবনা থেকে কল্যাণরাষ্ট্র ভাবনায় এসেছি আমরা। এটি সময়ের প্রয়োজনের ভাবনা। রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে তার বাস্তবায়নের জন্য আরও অগ্রসর ভাবনায় এগোক নাগরিক ঐক্য। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের প্রধান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ যেটি রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছে। এই দেশের মানুষ কী চায়, তাদের কী আকাঙ্ক্ষা তা যদি আমরা বুঝি, অতীত প্রেক্ষাপট যদি আমরা জানি তবে বলতে হবে বাংলাদেশে কল্যাণরাষ্ট্র বাস্তবায়ন সম্ভব এবং আমরা এ-দেশের মানুষ এরই প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছে।’ 

আলোচনা সঞ্চালনা করেন নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডাক্তার জাহেদুর রহমান। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দলের সমন্বয়ক শহীদুল্লাহ কায়সার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিনুল ইসলাম, জিন্নুর চৌধুরী দিপু, মোফাখখারুল ইসলাম নবাব, মাহবুব মুকুল, আনিসুর রহমান খসরু, মঞ্জুর কাদির, বেগ শাহিন জাহান, শাহনাজ রানু, এডভোকেট নজরুল ইসলাম, ফরিদুল ইসলাম, লুতফুন্নাহার মিনু, ফেরদৌসি আক্তার, ইকবাল কবীর, শিউলি আক্তার রুবি, আতিকুল ইসলাম, এস এম এ কবীর হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সোনালীনিউজ/এমএস

Wordbridge School
Link copied!