ঢাকা : বিএনপির ‘মহাসমাবেশের’ দিন পুলিশ, সাংবাদিক, সরকারি সম্পদের ওপর হামলা ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় ‘অনেক মামলা হবে’ বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিএনপি বর্বরোচিত ও জঘন্যতম উদাহরণ সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব ঘটনার জন্যই আলাদা আলাদা মামলা হবে। পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়েও মামলা দেবে।
সংঘর্ষের পরদিন রোববার (২৯ অক্টোবর) বিএনপির ডাকে হরতাল চলাকালে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ঘটনা অনেকগুলো ঘটেছে। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে অ্যাটাক করেছে, বাড়িতে ঢুকে গিয়েছে, এ মামলা তো হবেই। আমরা শনাক্ত করছি, যারা যারা এখানে ঢুকেছিলেন, যার যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদেরকে অবশ্যই আইনের মুখোমুখি হতে হবে।
প্রধান বিচারপতির বাড়িতে আক্রমণ হল, এর দায় কি তারা এড়াতে পারবেন? পুলিশ হত হল, এর দায় কি তারা এড়াতে পারবেন? পুলিশের তিনটি অস্ত্র তারা জোর করে নিয়ে গেছে, এর দায় কি তারা এড়াতে পারবেন?
মন্ত্রী বলেন, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে যারা অগ্নিসংযোগ করেছেন, এখানে যারা গাড়ি পুড়িয়েছেন তাদের নামে মামলা হবে। যতগুলো গাড়ি পুড়িয়েছে, এস আলমের একটি গাড়ি পুড়িয়েছে, তার মামলা হবে। পুলিশ হাসপাতালে যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তাদের নামে মামলা হবে।
এখন পর্যন্ত কতগুলো মামলা হয়েছে, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, মামলা তো শুরু হয়েছে। মামলা অনেকেই দেবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা মামলা দেবে। সাংবাদিকরা মামলা দেবে। পুলিশ হাসপাতাল মামলা দেবে।
যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা মামলা দেবে। পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে যেগুলো দেওয়ার সে মামলা দেবে। মামলা শুরু হয়েছে। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে তাদের নামে মামলা দেব।
বিএনপির হরতাল ডাকাতেও বিস্ময়ও প্রকাশ করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, আহত হল পুলিশ, ক্ষতিগ্রস্ত হল মানুষের গাড়িঘোড়া আর হরতাল ডাকে বিএনপি! যারা নিজেরাই এই ঘটনাটা ঘটলো তারাই আবার হরতাল ডাকে!
তারা কি দায় এড়াতে পারবেন?
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, তারা মিটিং করেছেন, যারা উসকানি দিয়েছেন, বলেছেন কালকে থেকে লাগাতার ওমুক-তমুক, এই সমস্ত করে জনতাকে উত্তেজিত করেছেন, এই দায় কি তারা এড়াতে পারবেন? এটা বিচার বিভাগ দেখবে, আমরা তাদের সম্মুখে নিয়ে যাচ্ছি। আইন অনুযায়ী বিচার বিভাগ দেখবে।
মির্জা ফখরুলসহ যাদের আটক করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা মিটিং করছিল। যখন মিটিংয়ে বসেছিলেন, তখনই ঘটনাগুলো ঘটছে। তাহলে এর দায় কি তারা এড়াতে পারেন?
যে ছাত্রদল নেতার আঘাতে পুলিশ মারা গেছে বলে জানিয়েছেন, তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি কেন, এ প্রশ্নে কামাল বলেন, অ্যারেস্ট আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। ক্যামেরা কিছু ভেঙে ফেলেছে, অকার্যকর করে দিয়েছে, তারপরেও আমাদের অনেক ধরনের ক্যামেরা ছিল, ক্যামেরার মাধ্যমে আমরা যাদেরকে চিহ্নিত করব তাদেরকে আমরা অবশ্যই আইনে হাতে সোপর্দ করব।
যিনি এটা ঘটিয়েছেন (পুলিশ হত্যা) তিনি অসুস্থ হয়ে গেছেন, পেটালেন পুলিশকে আবার তিনিই অসুস্থ হয়ে গেলেন!
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর বেপরোয়া আক্রমণের অভিযোগ এনে মন্ত্রী বলেন, পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, আরেকজন পুলিশ আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে, তিনিও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। দুইজন আনসার সদস্য মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আমার জানামতে শতাধিক পুলিশ বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে, বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আনসার বাহিনী হাসপাতালে রয়েছে। আওয়ামী লীগের মহিলা কর্মীদের তারা পিটিয়েছে, গায়ে হাত তুলেছে, তারাও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রোববার দুপুর পর্যন্ত পুলিশ কতজনকে গ্রেপ্তার করেছে সেই তথ্য জানাতে পারেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমার কাছে এ তথ্য নেই। আমি আপনাদের পরে জানাতে পারব।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা প্রসঙ্গ : সাংবাদিকদের ওপর বেপরোয়া হামলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, আমি তো মনে করি আপনারা (সাংবাদিক) সে ব্যাপারে সোচ্চার হবেন। যেসব সাংবাদিক আহত হয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই সোচ্চার হবেন এবং মামলা দেবেন, আমরা সব মামলা নেব।
যা ঘটেছে : নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন ও বর্তমান সরকারের পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবিতে শনিবার ঢাকায় বিএনপির ‘মহাসমাবেশ’ আহ্বানের পর রাজনীতিতে উত্তাপ তৈরি হয়। দলটির ঘোষণা ছিল, এদিন থেকে তাদের আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ শুরু হবে।
একই দিন আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীও রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দিলে উত্তাপ আরও বাড়ে। আগের দিন রাতে দুই দলকে তাদের পছন্দের স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দিলে রাজনৈতিক বিরোধ কিছুটা কমার আভাস মেলে। তবে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়।
জামায়াত অনুমতি না পেলেও সেই সমাবেশ করেছে। তবে নয়া পল্টনের অদূরে কাকরাইল ও বিজয়নগরে সংঘর্ষের পর পণ্ড হয়ে যায় বিএনপির সমাবেশ। এরপর দলটির পক্ষ থেকে রোববার সারা দেশে হরতালের ডাক দেওয়া হয়।
সমাবেশের দিন সংঘর্ষের মধ্যে ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু গাড়িতে, সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে ব্যাপক।
সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৩০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে পেটানো হয়েছে। তাদের অনেকে এখন হাসপাতালে ভর্তি।
হামলা হয়েছে প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও। পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে এক পুলিশ সদস্যকে, যার জন্য ছাত্রদলের এক নেতাকে দায়ী করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, তাদের কাছে ছবি আছে।
পুলিশের ওপর হামলার বেশ কয়েকটি ভিডিও ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে। যুবদলের এক নেতারও মৃত্যু হয়েছে এদিন।
বিএনপি হরতাল ডাকার পর রাজধানীতে বেশ কিছু গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকালে আটক করা হয়েছে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে।
নাশকতার ‘আগাম তথ্য ছিল’ : এক প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নাশকতা করতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তবে যা ঘটেছে তা তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছে।
তিনি বলেন, আমরা কি বিশ্বাস করতে পারি একটি সভ্য মানুষ একজন পুলিশকে হত্যা করবে? দেখিয়ে দিল তারা কতখানি নৃশংস, কতখানি বর্বর।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলনের কথা স্মরণ করে মন্ত্রী বলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে মানুষ পুড়িয়েছে। জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য পুলিশ বাহিনী ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করছে।
শনিবারের ঘটনার জন্য পুরোপুরি বিএনপিকে দায়ী করে তিনি বলেন, আমরা এতগুলো ভিডিও দেখলাম। সমাবেশ শেষ হওয়ার আগে কোনো পুলিশ সেখানে যায়নি, কোনো আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীও সেখানে বাধা দেয়ার জন্য যায়নি।
জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি : জামায়াতের সমাবেশ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা সেখানে অবস্থান নিয়েছিল, আমরা তাদের কিছু বলিনি। আমরা ধৈয্য সহকারে মোকাবিলা করেছি। জামায়াতেকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বিএনপির কার্যালয়ে বিদেশির সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গে : বিএনপির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক বিদেশি নাগরিকের উপস্থিতি নিয়েও কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সেই বিদেশি নিজেরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা দাবি করে বলেছিলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর বিনা উসকানিতে আক্রমণ করা হয়েছে। তিনি বাইডেনকে সব কিছু জানাবেন।
সেই ব্যক্তি সংবাদ সম্মেলন করার সময় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরে অবশ্য বিএনপির মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে একজনের সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্য রাখার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিবের কোনো ধারণা নেই।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকেও কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সেই ব্যক্তির বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপি কোনোভাবেই অবহিত নয়।
এই বিষয়টি নিয়ে এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, বিদেশি একজন নাকি এসে তাদের সমর্থন করছে, আমরা এই বিদেশির পরিচয় জানি না। তিনি একজন আমেরিকান, তার সঙ্গে নাকি জো বাইডেসের সরাসরি কথা হয়, তিনি এগুলো বলেছেন। বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে তিনি গোপন বৈঠক করেছেন।
তাকেও জিজ্ঞাসা করি তিনি কীভাবে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণ করলেন? তিনি কে, তিনি যদি উপদেষ্টা হয়ে থাকেন তাহলে আমার প্রশ্ন রয়েছে। পররাষ্ট্র যে নীতি-নৈতিকতা কতখানি লংঘন করেছে সেখানেও আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।
এমটিআই