ঢাকা : দ্বিতীয় দফা বৈঠকে বসেও আসন ভাগাভাগি নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলীয় জোটের নেতারা। তবে দুয়েক দিনের মধ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে শরিক নেতারা আশা করছেন।
রোববার (১০ ডিসেম্বর) রাতে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য ভবনে (ন্যাম ফ্লেটে) আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়।
চৌদ্দ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ জোটের নেতারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বৈঠক শেষে বলেন, অত্যন্ত সোহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আমরা আলোচনা করেছি। ১৪ দলীয় জোট একসঙ্গে নির্বাচন করবে। ১৪ দলীয় জোটের যারা প্রার্থী হবেন, তারা নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন।
তবে আসন বণ্টনের বিষয়টি আওয়ামী লীগ এখনও ‘বিবেচনা করছে’ জানিয়ে সাবেক তথ্যমন্ত্রী ইনু বলেন, আজকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আসন বণ্টনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। তারা আরো দুই-এক দিন সময় চেয়েছেন। দুই-একদিনের ভেতরে চূড়ান্ত করলেই ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীদের তালিকা আমরা দেশবাসীকে জানাতে পারব।
তিনি বলেন, ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা এখনো নিষ্পত্তি করতে পারিনি আওয়ামী লীগ। কোন দলের কে প্রার্থী হবেন, কোন আসন থেকে হবেন, সেই তালিকাটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আওয়ামী লীগের সাথে জোটগত আসনগুলো ছাড়া বাকি আসনগুলো উন্মুক্ত থাকবে। প্রতিটি দল তাদের প্রতীকে নির্বাচন করবে।
২০০৮ সাল থেকেই ১৪ দল ও আওয়ামী লীগ জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে আসছে। তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুটিতে জোটের শরিক হিসেবে ছিল জাতীয় পার্টিও।
তবে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের পর জাতীয় পার্টি জোটে ছিল না। এবারও বিএনপি ভোটে আসেনি, জাতীয় পর্টিকেও জোটে রাখা হয়নি।
২০১৪ সালে জোট না থাকলেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী আছে, এমন ৩৪টি আসনে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। সেসব আসনেই জয় পায় দলটি। একাদশে জোট করার পর তাদেরকে দেওয়া হয় ২৬টি আসন, এর মধ্যে তারা জয় পায় ২৩টিতে। এবার দলটিকে কোথাও ছাড় দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি আওয়ামী লীগ।
গত নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকদেরকে ১৬টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ১৪টিতে প্রার্থীরা ভোট করে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায়, জাতীয় পার্টি (জেপি) দুইজন প্রার্থী তাদের দলীয় প্রতীক বাইসাইকেল নিয়ে ভোটে অংশ নেয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫টি আসন পায় ওয়ার্কার্স পার্টি। আসনগুলো ছিল ঢাকা-৮, রাজশাহী-২, বরিশাল-৩, ঠাকুরগাঁও-৩ ও সাতক্ষীরা-১। এর মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী ও সাতক্ষীরায় জয় পায় দলটি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ পায় তিনটি আসন। এগুলো হল কুষ্টিয়া-২, ফেনী-১ ও বগুড়া-৪। দলটির দুই নেতা জয় পান কুষ্টিয়া ও ফেনীতে।
বিকল্পধারাকে দেওয়া হয় মুন্সীগঞ্জ-১ ও লক্ষ্মীপুর-৪ ও মৌলভীবাজার-২ আসন। তাদের প্রার্থীরা জয় পান মুন্সীগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরে।
তরীকত ফেডারেশন পায় লক্ষ্মীপুর-১ ও চট্টগ্রাম-২ আসন। দলটির প্রার্থী জয় পান চট্টগ্রামে।
জাতীয় পার্টি (জেপি) পায় কুড়িগ্রাম-৪ ও পিরোজপুর-২ আসন; এর মধ্যে জয় পায় পিরোজপুরে।
বাংলাদেশ জাসদ পায় চট্টগ্রাম-৮ আসন। সেই আসনে বিজয়ী প্রার্থী মইন উদ্দীন খান বাদল ২০২০ সালে মারা গেলে আওয়ামী লীগের নেতা মোসলেম উদ্দিন আহমেদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তারও মৃত্যু হয় ২০২৩ সালে। গত ২৭ এপ্রিল আবার উপনির্বাচন হলে জয় পান আওয়ামী লীগের নোমান আল মাহমুদ।
এই আসনগুলোর বাইরে আরও অনেকগুলোতে এসব দলের একক প্রার্থী ছিল গত নির্বাচনে।
এবার দুটি আসন ছেড়ে ২৯৮ আসনেই প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে তারা জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে যাবে, এ কথা নির্বাচন কমিশনে লিখিতভাবে জানিয়েছে আগেই। একইভাবে ১৪ দলের শরিক দলগুলোও আলাদাভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে।
কোন কোন আসনে সমঝোতা হবে, তা ঠিক করতে গত ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জোট শরিকদের নিয়ে গণভবনে বসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তবে ওই বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি,পরদিন তা জানিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছিলেন, চৌদ্দ দলের সাথে আমাদের একটা সমঝোতা অবশ্যই হবে। এ ব্যাপারে আমু ভাই (আমির হোসেন আমু) আমাদের সমন্বয়ক। বিষয়টি আজ-কালের মধ্যেই সমাধান হয়ে যাবে।
তার এক সপ্তাহের মাথায় রোববার দ্বিতীয় দফা বৈঠকেও যে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা যায়নি, বৈঠক শেষে বেরিয়ে তা জানান ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত হয় নাই। আজকে একটি বিষয় আলোচনা হয়েছে, সেটা হচ্ছে সিট সমঝোতা। তারা (আওয়ামী লীগ) বলেছে আলোচনা করবে। আমার কাছে মনে হয়েছে তারা এখনো প্রস্তুত করতে পারে নাই।
তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, আমাদের অনেকগুলো লিস্ট দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর সঠিক সমন্বয় এখনও আসেনি। সেই লিস্টগুলো নিয়ে এখন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
জটিলতা কোথায়, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা যারা চারজন সংসদে আছি, নিশ্চিত তারা নৌকা নিয়েই নির্বাচন করবে। একটু সমস্যা হয়েছে, সেটা হচ্ছে মেনন ভাই কোথায় করবে?
তবে আমরা কিন্তু সবাই জানি সে কোথায় করতে পারে। এই চারজনের সাথে যারা যুক্ত হবেন সেটা নিয়েই সমস্যা হচ্ছে। লিস্টটা ছিল লম্বা, সেখান থেকে আমরা শর্ট করে আজকে নিয়ে এসেছি। যাদের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো চূড়ান্ত করতে দুই তিন দিন সময় নিয়েছেন।
রাশেদ খান মেনন গত তিনবার ঢাকা-৮ আসন থেকে এমপি হলেও এবার তাকে সেখানে ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। এ আসনে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম।
সে কারণে মেনন ফিরে গেছেন তার নিজ জেলায়, মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বরিশাল-২ ও ৩ আসনে।
এই দুটি আসনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, একটি আসন মেননকে দেওয়া হবে সেখানে।
নজিবুল বশর বলেন, কোথায় কে জিতবে, এটাও দেখার বিষয়, বর্তমান যে জায়গাটা আছে সেটাও দেখতে হবে। আমি মনে করি যথার্থ সুন্দর আলোচনা হয়েছে। একটা জিনিস স্পষ্ট করা হয়েছে, নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবে এবং নৌকা উঠে আসবে।
তিনি বলেন, ১৪ দলের লিস্ট নিয়েই প্রধানমন্ত্রী চার বার ভোট করেছেন। প্রধানমন্ত্রী খবর নিয়েছেন, কোথায় থেকে কে উঠে আসতে পারেন। এগুলো নিয়ে বাকি একটু যাচাই-বাছাই করে আর দুয়েকদিনের মধ্যে বলে দেবেন।
এটা ভুললে চলবে না, নির্বাচনের পরে একটা কঠিন সময় আসতেছে। সময় জোটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমি মনে করি ১৫ তারিখের মধ্যে চূড়ান্ত হওয়া দরকার, ১৫ তারিখের মধ্যেই চূড়ান্ত হবে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার সুযোগ আছে। সেদিনই জানা যাবে, কারা হবেন চূড়ান্ত প্রার্থী। শেষ দিন জোটের প্রধান দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তার নিজের ও শরিকদের নাম পাঠাবে নির্বাচন কমিশনে।
১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হবে ভোটের প্রচার, যা চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। সব শেষে আগামী ৭ জানুয়ারি হবে ভোটগ্রহণ।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :