ঢাকা: সবশেষ গত নির্বাচনের তুলনায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ৩৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।আগামী ৭ জানুয়ারির ভোটের লড়াইয়ে ৩০০ আসনের বিপরীতে ১ হাজার ৮৯৫ প্রার্থীর মধ্যে নারী রয়েছেন ৯৪ জন। এর মধ্যে ২৬ জন লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। আর নির্বাচনে আসা ২৭টি রাজনৈতিক দলের ১৪টি মনোনয়ন দিয়েছে ৬৮ নারীকে।
অর্থাৎ মোট পুরুষ প্রার্থীর তুলনায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে লড়ছেন ৫ শতাংশ নারী। সেইসঙ্গে ভোটের মাঠে আছেন ট্রান্সজেন্ডার দুই প্রার্থী।
নির্বাচনে প্রধান দল আওয়ামী লীগ নারী প্রার্থী করেছে ২০ জনকে। জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপি নয়জন করে, তৃণমূল বিএনপির ছয়জন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ তিনজন করে এবং গণফ্রন্ট ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি দুইজনকে করে নারী প্রার্থী রেখেছে।
এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাতীয় পার্টি-জেপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি একজন করে নারী প্রার্থী দিয়েছে।
পুরুষের বিপরীতে নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ কমের পেছনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর জয়-পরাজয়ের হিসেব-নিকাশকেই কারণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু মজুমদার।
তার ভাষায়, “দল থেকে যখন মনোনয়ন দেওয়া হয়, তখন এই প্রার্থী জিতবে কিনা- সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়।”
গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নারী নেতৃত্বের হাতেই থাকছে। সংসদ ও সংসদের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীদের দেখা যাচ্ছে। তবে সামগ্রিক রাজনীতিতে নারীর পিছিয়েই থাকছে।
সংরক্ষিত আসনে প্রতিনিধিত্ব করতে ৫০ জন নারী জাতীয় সংসদে যান। তবে জনরায় নিয়ে এর অর্ধেক নারীও কোনো সংসদে যেতে পারেননি। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে ৩৯ জন নারী প্রার্থী অংশ নেন, যাদের মধ্যে পাঁচজন জয়ী হয়ে সংসদে যান।
ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে ৩৬ নারীর প্রার্থীর আটজন, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৮ নারী প্রার্থীর ছয়জন, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৯ নারীর মধ্যে ১৯ জন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯ নারী প্রার্থীর ১৮ জন নির্বাচিত হন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬৯ আসনে জনপ্রতিনিধি হতে লড়েন ৬৮ নারী, যাদের মধ্যে রেকর্ড ২২ জন সরাসরি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, “ঘরের বাইরে নারী আসার ক্ষেত্রে আমাদের ভালোই অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। যে নারীদের রাজনীতিতে দেখা যায়, তাদের বিরাট অংশ পরিবার থেকে উঠে আসে।”
সমাজ ও রাজনৈতিক দলের ভেতরে নারী বিদ্বেষী মনোভাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যে নারীরা ফাইট করে দলের জায়গায় যান, তাদের প্রত্যেককে যখন আটকানো যায় না, তখন নারী উইংয়ে ঠেলে দেওয়া হয়। ফলে তারা মূল দলে জায়গা করে নিতে পারেন না।
“সমাজ ও দলের ভেতরের মানসিকতার পবির্তন না হলে এই অবস্থার কোন উন্নতি হবে না।” ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন ১৮ জন নারী। এবার দলটি ২০ নারীকে নৌকার টিকেট দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, “নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা শুরু থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। নারীদের সমাজের বিভিন্ন পেশায় উচ্চপদস্থ করার প্রয়াস নিয়েই তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচনের জন্য অনেক নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।”
আওয়ামী লীগ: (রংপুর-৬), উম্মে কুলসুম স্মৃতি (গাইবান্ধা-৩), সাহাদারা মান্নান (বগুড়া-১), জান্নাত আরা হেনরী (সিরাজগঞ্জ-২), হাবিবুন নাহার (বাগেরহাট-৩), সুলতানা নাদিরা (বরগুনা-২), মতিয়া চৌধুরী (শেরপুর-২), নিলুফার আঞ্জুম (ময়মনসিংহ-৩), সৈয়দা জাকিয়া নূর (কিশোরগঞ্জ-১), মমতাজ বেগম (মানিকগঞ্জ-২), সাগুফতা ইয়াসমিন (মুন্সীগঞ্জ- ২), সানজিদা খানম (ঢাকা-৪), রুমানা আলী (গাজীপুর-৩), সিমিন হোসেন রিমি (গাজীপুর -৪), মেহের আফরোজ চুমকি (গাজীপুর-৫), শেখ হাসিনা (গোপালগঞ্জ-৩), সেলিমা আহমাদ (কুমিল্লা-২), দীপু মনি (চাঁদপুর-৩), খাদিজাতুল আনোয়ার (চট্টগ্রাম-২) ও শাহীন আক্তার (কক্সবাজার-৪)।
জাতীয় পার্টি: সালমা ইসলাম (ঢাকা-১), মিথিলা রোয়াজা (খাগড়াছড়ি), হোসেন আরা (কক্সবাজার-১), জোনাকি হুমায়ূন (কুমিল্লা-১০), শেরীফা কাদের (ঢাকা-১৮), রহিমা আক্তার আসমা সুলতানা (নেত্রকোণো-২), নাসরিন জাহান রত্না (বরিশাল-৬), মনিকা আলম (ঝিনাইদহ-১) ও নুরুন নাহার (ঠাকুরগাঁও-২)।
বাংলাদেশ কংগ্রেস: রিম্পা আক্তার (ঠাকুরগাঁও-২), শ্যামলী রায় (রংপুর-১), শান্তি রিবারু (নাটোর-৪), মনিরা সুলতানা (খুলনা-৪), রূপা রায় চৌধুরী (টাঙ্গাইল-৭), নূর জাহান বেগম রিতা (মুন্সীগঞ্জ-১), রেহানা আক্তার রীনা (গাজীপুর-২), মমতাজ মহল (নরসিংদী-৫) এবং নাজমুন নাহার (ফরিদপুর-৪)।
এনপিপি: পারুল সরকার লিনা (দিনাজপুর-৩), আজিজা সুলতানা (দিনাজপুর-৪), মর্জিনা খান (গাইবান্ধা-১), আলেয়া (কিশোরগঞ্জ-২), দোয়েল আক্তার (মুন্সীগঞ্জ-১), নাজমা বেগম (ঢাকা-১৫), রেবেকা সুলতানা (ঢাকা-২০), নুরুন্নেসা (রাজশাহী-১) ও জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না (রাজশাহী-৪)।
তৃণমূল বিএনপি: মরিয়ম সুলতানা (বাগেরহাট-২), লুৎফুন্নাহার রিক্তা (বাগেরহাট-৪), সুমি (সাতক্ষীরা-১), পারুল (টাঙ্গাইল-৮), অন্তরা সেলিমা হুদা (মুন্সীগঞ্জ-১) ও রুবিনা আক্তার রুবি (ঢাকা-৯)।
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট: ফাহমিদা হক সুকন্যা (ঢাকা-১৮), নূর জাহান বেগম (ঢাকা-৭) ও রোকেয়া বেগম (ময়মনসিংহ-১)।
বিএনএফ: মমতাজ সুলতানা আহমেদ (মুন্সীগঞ্জ-৩), সাদিকুন নাহার খান (ঢাকা-১১) ও শাহেরা বেগম (কুমিল্লা-৪)।
গণফ্রন্ট: তাহমিনা আক্তার (ঢাকা-৯) ও সৈয়দা লিমা হাসান (গোপালগঞ্জ-৩)।
বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি: আফরিনা পারভীন (বগুড়া-৩) ও মিরানা জাফরিন চৌধুরী (নরসিংদী ৩)।
এছাড়া বিএনএমের হয়ে পাবনা-২ আসনে ডলি সায়ন্তনী, গাইবান্ধা-১ আসনে আইরিন আক্তার কল্যাণ পার্টির, নড়াইল-১ আসনে শামীম আরা পারভীন ইয়াসমিন জাতীয় পার্টির (জেপি), পাবনা-১ আসনে পারভীন খাতুন জাসদের, ঢাকা-১৯ আসনে আইরিন পারভীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছেন।
এর বাইরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনে ২৬ জন নারী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন।
তারা হলেন- আশা মনি (ঠাকুরগাঁও-৩), মার্জিয়া সুলতানা (নীলফামারী-৩), তাকিয়া জাহান চৌধুরী (রংপুর-৬), মাসুমা আক্তার (গাইবান্ধা-২), ফারজানা রাব্বী বুবলী (গাইবান্ধা-৫), শাহজাদী আলম লিপি (বগুড়া-১), চন্দনা হক (নড়াইল-১), বিউটি বেগম (বগুড়া-২), মাহফুজা আকরাম চৌধুরী (নওগাঁ-৩), শারমিন আক্তার নিপা মাহিয়া (রাজশাহী-১), মুনিয়া আফরিন (ঝিনাইদহ-১), ফাতেমা জামান সাথী (খুলনা-৩), নাজনীন আলম (ময়মনসিংহ-৩), সেলিমা বেগম (ময়মনসিংহ-৬), কানিজ ফাতেমা (ময়মনসিংহ-৮), জান্নাতুল ফেরদৌস আরা (নেত্রকোণা-১), সোহানা তাহমিনা (মুন্সীগঞ্জ-২), চৌধুরী ফাহরিয়া আফরিন (মুন্সীগঞ্জ-৩), সাবিনা আক্তার তুহিন (ঢাকা-১৪), আফরোজা সুলতানা (নরসিংদী-২), তাহমিনা বেগম (মাদারীপুর-৩), জয়া সেন গুপ্ত (সুনামগঞ্জ-২), আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী (হবিগঞ্জ-১), আঞ্জুম সুলতানা (কুমিল্লা-৬) চৌধুরী রুবিনা ইয়াছমিন লুবনা (লক্ষ্মীপুর-২) এবং মাহমুদা বেগম (লক্ষ্মীপুর-৪)।
ট্রান্সজেন্ডার দুই প্রার্থী
এবারের নির্বাচনে ট্রান্সজেন্ডার দুই প্রার্থীও ভোটে লড়ছেন। এর মধ্যে রংপুর-৩ আসনের আনোয়ারা ইসলাম রানী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। আর গাজীপুর-৫ আসনের উর্মি বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির প্রার্থী হয়েছেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির দপ্তর সম্পাদক ইব্রাহিম মিয়া বলেন, “নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ হিসেবেই তারা নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছেন।
“নারী প্রার্থী রাখতে হবে এটার জন্য নয়, আমরা যদি আরও বেশি নারী প্রার্থী পেতাম তাহলে আরও দিতাম। আমাদের সমাজে এখনও নারীরা ‘অনগ্রসর’। আগের চেয়ে অগ্রসর হয়েছে ঠিক, কিন্তু যতটা হওয়া উচিত ততটা এখনও হয়নি।”
এআর