ঢাকা: আওয়ামী লীগের নৌকা যে টানা চতুর্থবার জয়ের বন্দরে ভিড়তে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সংশয় কারো ছিল না। জল্পনা-কল্পনা ছিল দ্বিতীয় অবস্থান নিয়ে, সেখানে চমক দেখালেন আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্ররা।
সবমিলিয়ে আসনের সংখ্যায় দৃশ্যত আবারও সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। তবে সংখ্যায় তাদের পাঁচগুণ বেশি স্বতন্ত্ররা সম্ভাব্য ওই তকমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
বিএনপিসহ নিবন্ধিত ১৫টি দলের বর্জনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম ভোটারের উপস্থিতিতে ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনে আবারও দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ; ভোট হওয়া ২৯৯ আসনের মধ্যে ২২৩টি পেয়ে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে দলটি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থিরা, যাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। ৬১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।
গত দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত ১১ আসনে জয় পেয়েছে। যে ২৬ আসনে আওয়ামী লীগ লাঙ্গলকে ছাড় দিয়েছিল, তার অর্ধেকের বেশি আসন তারা খুইয়ে বসেছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে জাসদ একটি, ওয়ার্কার্স পার্টি একটি এবং এক সময় বিএনপির জোটে থাকা কল্যাণ পার্টি একটি আসনে জয় পেয়েছে।
একটি কেন্দ্র স্থগিত থাকায় ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের ফল স্থগিত রেখেছে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়। সেই আসনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী এগিয়ে আছেন।
লাঙ্গলে প্রতীকে জয়ী ১১টি আসন নিয়ে দৃশ্যত আবারও সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। তবে সংখ্যায় তাদের পাঁচগুণ বেশি স্বতন্ত্ররা সম্ভাব্য ওই তকমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
ভোটে না আসায় দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি দশম সংসদের মতই সংসদের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ভোট প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে থাকা দলটির নেতা মঈন খান বলেছেন, তাদের ভোট বর্জন ‘সফল’ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রদের দাপটে লাঙ্গলের দুর্দশা বুঝতে পেরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ভোটের মাঝপথেই বলেছিলেন, “আমাদেরকে ভোটে নিয়ে এসে কোরবানি দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয় কি-না সেটা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।”
আর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দিনের শুরুতেই ভোট দিয়ে বলেছিলেন, নৌকার জয় হবেই, কোনো সন্দেহ তার নেই।
“আজকে নির্বাচনটা যে আমরা সুষ্ঠুভাবে করতে পারছি, সে জন্য আমি আমার দেশের মানুষের প্রতি, দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, বলেছিলেন তিনি।
যেমন ভোট হল
দেড় দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা বজায় রেখে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে টানা চতুর্থবার সরকার গঠনের জন্য ভোটের আগে নৌকায় ভোট চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
বিএনপি ও তার মিত্রদের ডাকা হরতালের মধ্যে রোববার সকাল ৮টা থেকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়; বিকাল ৪টা পর্যন্ত দেশের ২৯৯ আসনের ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে সাতটির ভোটগ্রহণ স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।
ইসি সচিব জাহাংগীর আলম জানিয়েছেন, জাল ভোট পড়ায় এবং ভাঙচুর হওয়ায় এসব কেন্দ্রের ভোট বাতিল হয়েছে। বিকালে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “ছোটখাটো ৩০-৩৫টি জায়গায় ভোটকেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও আমাদের পুলিশ অফিসারের গাড়ির গ্লাস ভাঙচুর করা হয়েছে। কোথাও ভোটকেন্দ্রের পাশে ককটেল ফোটানো হয়েছে। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি।"
ভোট চলাকালে রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার টেঙ্গর শাহী মসজিদ তিন রাস্তার মোড়ে একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন নৌকা প্রতীকের এক সমর্থক। এছাড়া চট্টগ্রামসহ আরও কিছু স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘাত, এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ, আর ডজন দুয়েক আসনে লাঙ্গলের প্রার্থীদের বর্জনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ভোটগ্রহণ।
শেষ পর্যন্ত কত শতাংশ ভোট পড়েছে, তা রোববার রাতে স্পষ্ট করেনি নির্বাচন কমিশন। তবে ভোটের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল আভাস দিয়েছিলেন, সেই হার ৪০ শতাংশের মত হতে পারে।
ভোট ঘিরে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে; জাল ভোট দেওয়ায় বা সে কাজে সহায়তা করায় এদিন ১৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। দণ্ডিতদের মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারও আছেন।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ভোটগ্রহণের মাত্র ১৫ মিনিট বাকি থাকতে প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
তার প্রার্থিতা বাতিলের কারণ ব্যাখ্যা করে নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম বলেন, "তিনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হুমকি দিয়েছেন, তাদের উপর চড়াও হয়েছেন। সব বিবেচনায় নিয়ে কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করেছে।”
ভোট শুরুর আগে এবং ভোট চলার সময় রাজধানীর তিনটি কেন্দ্রের বাইরে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন শিশুসহ চারজন।
ঢাকার শান্তিনগরে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
ভোটকেন্দ্রগুলোতে সব প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট রাখার বিষয়ে বারবার জোর দিলেও ভোটের সকালে তেমনটি দেখেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “ভোটকেন্দ্রগুলোতে (সব প্রার্থীর) পোলিং এজেন্ট নেই। আসলে মনে হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষ প্রার্থী যারা, অনেকেরই বোধ হয় সে সামর্থ্য (পোলিং এজেন্ট দেওয়ার) নেই, যা আমি এক্সপেক্ট করেছিলাম।”
দেশের প্রায় ২১ হাজার পাশাপাশি দেড় শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচনে ছিলেন। ভোটের পরিবেশ ও উপস্থিতির প্রশংসা করেছেন পর্যবেক্ষকদের একটি অংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের এনডিআই ও আইআরআই, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওলেয়থ এবং জাপানি পর্যবেক্ষকদের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
ফল ঘোষণায় হঠাৎ যতি
ভোটের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজবাড়ী-১ আসনের আংশিক ফলাফল জানানোর মধ্য দিয়ে ঢাকার নির্বাচন ভবন থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পরিবেশনের কার্যক্রম শুরু হয়।
নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একের পর ফলাফল ঘোষণা করতে থাকেন।
ফলাফল ঘোষণা হলেও কোন দল কয়টি আসন পেয়েছে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কত আসন পেয়েছেন তা চূড়ান্তভাবে জানাননি তিনি। তবে ডিজিটাল স্ক্রিনে দলগত ভোটের পরিসংখান দেখানো হচ্ছিল।
অঙ্কের খেলা
১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয় পেয়েছিল। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩৪টি আসন। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে পায় ২৫৯টি আসন, আর মহাজোটগতভাবে তাদের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮টি।
১৪ দলীয় জোটের দলগুলোর মধ্যে জাসদ ২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, বিকল্প ধারা ২টি, তরীকত ফেডারেশন একটি আসনে জয় পায় গতবার (২০১৮ সালে)। এর বাইরে আওয়ামী লীগের মিত্র দল জাতীয় পার্টি (জেপি) বাইসাইকেল প্রতীকে একটি আসন পায়।
এবার ২৯৯ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিল ২৬৫ জন। তাদের মধ্যে তিন ডজনের বেশি প্রার্থীর পরাজয়ের হিসাবে আওয়ামী লীগের আসন এবার গতবারের চেয়ে কম দেখাচ্ছে। তবে বিজয়ী হওয়া আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রদের যোগ করলে সংসদে আওয়ামী লীগের আইনপ্রণেতা থাকছেন ২৮৪ জন।
ডুবলেন যারা
দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবারের ভোটে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগেরই কয়েক ডজন নেতা। তাদের একটি বড় অংশ নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন, অন্যরা হারিয়েছেন সমঝোতার লাঙ্গলকে।
বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী দুইবারের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী দুই বারের সংসদ সদস্য এনামুর রহমান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী তিনবারের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য ভোটের লড়াইয়ে হেরে বসেছেন। তারা তিনজনই হেরেছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে।
স্বতন্ত্রদের কাছে হারের তালিকায় রয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ, টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, দলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাশ, মানিকগঞ্জের তিনবারের এমপি কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের নাম।
১৪ দলের প্রার্থীদের মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করেও হেরেছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।
এআর