ঢাকা: কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যুর পর ওই আসন শূন্য ঘোষণা করতে হলে সাধারণত তার মৃত্যুসনদ বা প্রমাণস্বরূপ কোনো কাগজ লাগে। আনারের মরদেহ না পাওয়ার ঘটনাটি ব্যতিক্রম হওয়ায় এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেও ওই আসনে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা থেমে নেই। দলীয় মনোনয়ন পেতে অনেকেই শুরু করেছেন দৌড়ঝাঁপ। আলোচনায় আছেন আনার ও এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যরাও।
প্রায় এক মাস হয়ে গেলেও আনারের আসনটি শূন্য ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন। এটি নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী আনারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু সংসদ সচিবালয় বলছে, সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আনারের মৃত্যুর বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
সংবিধানের ৬৭ ধারার ১ (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদের অনুমতি না নিয়ে কোনো সদস্য একনাগাড়ে ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে ওই সদস্যের আসন শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়। এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনকে জানায় সংসদ। নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে উপ-নির্বাচনের আয়োজন করে। সাধারণত কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যেই আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। আনারের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কী হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
এমপি আনার হত্যার ঘটনার পরই ওই আসন থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকার টিকিট পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে আসনটিতে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শোনা যাচ্ছে বেশ কয়েকজনের নাম। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা নানা কৌশলে প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন।
টানা তিনবারের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের অনুপস্থিতিতে তার উত্তরসূরি কে হচ্ছেন, তা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যেও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।
ঝিনাইদহ ও কালীগঞ্জ ঘুরে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি গ্রুপ পরিচালিত হতো আনোয়ারুল আজীম আনারের নেতৃত্বে। আর সাবেক এমপি আব্দুল মান্নানের অনুসারীরা আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। আনারের মৃত্যুর কারণে স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন কোনো মেরুকরণ ঘটবে কি না, এখনো তা স্পষ্ট নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের জেলা, উপজেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাসহ ১৪ জন দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এবার ধারণা করা হচ্ছে, ১৫ থেকে ২০ জন নৌকার টিকিটের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারেন।
বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপ-নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন তৎপরতা শুরু করেছেন। তারা দলীয় কর্মীদের নানাভাবে বার্তা দিচ্ছেন। আবার এখন পর্যন্ত সংসদ সদস্য আনারের মরদেহ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য না মেলায় নির্বাচন ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর বলে মনে করছেন অনেকেই।
এ কারণে কেউ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন না। তবে শেষ পর্যন্ত উপ-নির্বাচন হলে প্রার্থী হতে চান বলে জানিয়ে রাখছেন অনেকেই। তারা ফেসবুকে জনকল্যাণমূলক কাজের প্রচার করছেন। কেউ কেউ ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বাড়িয়ে দিয়েছেন যোগাযোগ।
জানা যায়, উপ-নির্বাচন হলে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান এসএম জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডু দলের মনোনয়ন চাইবেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর কালীগঞ্জে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করি। আমাদের হাত দিয়েই কালীগঞ্জে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপ-নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করবো।’
১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থীকে হারিয়ে। ২০১৯ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডু।
সাবেক এমপি আব্দুল মান্নানের সহধর্মিণী শামীমা আরা মান্নান ও ছোট ভাই আব্দুর রশিদ খোকনও নৌকার টিকিট চাইবেন। শামীম আরা মান্নান বলেন, ‘এমপি আনারের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে তার মৃত্যুর কারণে এ আসনে উপ-নির্বাচন হলে আমি প্রার্থী হবো। আমার স্বামী সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করবো।’জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইসরাইল হোসেন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেনও চান নৌকার মনোনয়ন।
আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘এমপি আনার আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। দলীয় মনোনয়ন চাইবো।’
এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বিজু, কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান মতি, কালীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অমিত শিকদার, যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শিবলী নোমানি এবং সাবেক ছাত্রনেতা কাজী নাসিম আল মোমিন রূপকসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ-২ আসনের ভোটার হলেও এ আসনে উপ-নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইতে পারেন। যদিও তিনি এমপি আনার হত্যার ঘটনায় এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি আগে থেকেই এ আসনে মনোনয়নের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন।
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনও নৌকার মনোনয়ন চাইবেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। তবে সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বয়স হয়েছে কি না তা নিয়েও রয়েছে আলোচনা। ডরিন মনোনয়ন না কিনলে আনারের পরিবার থেকে তার ভাই অথবা আনারের স্ত্রী মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
কালীগঞ্জ পৌরসভা, উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়ন নিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসন গঠিত। এখানে মোট ভোটার ৩ লাখ ১৫ হাজার ৬২০ জন। এর মধ্যে রয়েছেন পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৬, নারী ভোটার ১ লাখ ৫৬ হাজার ও তৃতীয় লিঙ্গের ৪ জন।
ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ ও ঝিনাইদহ সদরের আংশিক) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভারতের কলকাতায় মাংস ও কিছু হাড়ও পেয়েছে কলকাতার সিআইডি। তবে ডিএনএ টেস্টের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এগুলো আনারের কি না।
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতের কলকাতায় যান এমপি আনার। পরে ২২ মে হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনে আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় দুই দেশে গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েকজন।
এআর
আপনার মতামত লিখুন :