ঢাকা : বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রায় এক মাস হয়েছে। কিন্তু এখনও তার প্রশাসন এবং তার দলের লোকজন বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
মূলত বিগত ১৫ বছরে গুম-খুনে জড়িত শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী ও নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকর্তারা বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। আবার অনেকে আটকে পরলেও বিভিন্ন উপায়ে পালানোর চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশে বর্তমান এই অবস্থাকে স্বপ্নের মতো মনে করছেন দেশটির জনগণ। এমনই খবর প্রকাশ করেছে চীনা ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মরনিং পোস্ট।
প্রতিবেদনে বল হয়, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের প্রায় তিন সপ্তাহ পর ভারতে পলায়নের সময়্য আটক হন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তাকে ভারতীয় সীমান্তে আটক করেন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী এবং গ্রামবাসীরা।
পরবর্তীতে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাকে। পরে ২৪ আগস্ট মানিককে সিলেট আদালতে নেওয়া হলে হামলার শিকার হন তিনি। যার কারণে হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তার।
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অধিকার লঙ্ঘনের নথিভুক্তকারী ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্টের মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, “এটা বোঝা সহজ যে কেন মানুষ মানিকের উপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ‘।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা সরকার ভিন্নমতকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বিচার বিভাগকে দমনমূলক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানিক সেই বিচারকদের মধ্যে ছিলেন। ওই বিচারকরা বাংলাদেশে অন্যায়ের প্রতীক হয়েছিলেন।
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে গুম-খুন, নিপীড়নকারীদের ওপর জনগণ তীব্র ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে এবং দোষীদের সর্বোচ্চ বিচার চাচ্ছে। তবে, গণহত্যায় শেখ হাসিনার সহযোগী দোষী হাজারও নেতাকর্মী এবং পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়ছে, দোষীদের অনেকে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
শেখ হাসিনার প্রশাসনের পতনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, বিক্ষুব্ধ জনতা তার দলের সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মী ও পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু করে এবং তাদের কয়েক ডজনকে হত্যা করে। আর এসব হামলার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর শেখ হাসিনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
আবার পালানোর চেষ্টা করার সময় কয়েকজনকে ধরা হয়, পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
গত ৭ আগস্ট দেশের বাইরে পালানোর সময় ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। তিনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং তার প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের উপর সহিংসভাবে দমন করে শেখ হাসিনাকে সাহায্য করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বলপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অনেক মামলার মূল পরিকল্পনাকারী হওয়ার অভিযোগে তাকে ৬ আগস্ট চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
এছাড়া ১৩ আগস্ট নৌকায় করে পালানোর সময় গ্রেপ্তার হন শেখ হাসিনার প্রশাসনের বেসরকারি শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। কিছু মানুষ তাদের শনাক্ত করে এবং ১৬ জুলাই গুলিবিদ্ধ দুই ছাত্রকে হত্যার মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ নেতা ইসহাক আলী খান পান্না পলাতক ছিলেন। ২৬ আগস্ট ভারতের সীমান্ত রাজ্য মেঘালয়ে তার মরদেহ পাওয়া যায়। মৃতদেহের কাছে পাওয়া পাসপোর্ট থেকে তাকে শনাক্ত করা হয়। পোস্টমর্টেমে দেখা গেছে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
পলাতক মন্ত্রীরা : শেখ হাসিনা দেশত্যাগের এক মাস পার হলেও এখনও পলাতক দলের অনেক সংসদ সদস্য এবং হাসিনার মন্ত্রিসভার শীর্ষ মন্ত্রীরা। হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কোথায় তা এখনও জানা যায়নি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও পলাতক রয়েছেন।
এছাড়া শেখ হাসিনার পতনের পরপরই ভারতে পালিয়ে আসা আওয়ামী লীগের মধ্যম পর্যায়ের কিছু নেতা-কর্মী ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে। প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছে বলে জানান তারা।
এছাড়াও শেখ হাসিনার পতনের পরপরই, তার দলের অনেক সদস্যকে নিরাপত্তার জন্য ঢাকায় সেনা সেনানিবাসের ভিতরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। ১৮ আগস্ট, বাংলাদেশের সেনা কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল যে, তারা শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং সরকারী কর্মকর্তা সহ ৬২৬ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই কর্তৃত্ববাদ ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তার দলের বিরুদ্ধে গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, শেখ হাসিনার শাসনামলে দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে বলে জানায় দলের মুখপাত্র এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান।
বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ নেতা এবং এই দলের সাথে জড়িতরা যারা শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন করার জন্য দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল তাঁরা জনরোষের ভয়ে আত্মগোপনে গিয়েছেন।
ঢাকা-ভিত্তিক গণতন্ত্রপন্থী গ্রুপ সিটিজেনস ফর গুড গভর্ন্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা বদিউল আলম মজুমদার শেখ হাসিনার সরকারকে "ব্যাংক লুট এবং বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের মতো আর্থিক অপরাধের" জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
এমটিআই