ঢাকা: আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান। বিভিন্ন সময় জনগুরুত্বপূর্ণ এবং নানা অসংগতির বিরুদ্ধে কথা বলে তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হন তিনি। আওয়ামী লীগে তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও তার সাম্প্রতিক ভাবনা নিয়ে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তার সেই সাক্ষাৎকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
কেন পদত্যাগ করেছিলেন?
সোহেল তাজ: রাজনীতিতে অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম। আমেরিকায় লেখাপড়া করেছি। সেখানেই আমার সুন্দর ভবিষ্যৎ ছিল। কিন্তু ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ভেতর থেকে তাগিদ পেলাম, ‘দেশের জন্য কিছু করা দরকার।’ দেশে ফিরে অনেক বাধা পেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করি। ২০০১ সালে যখন আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়, তখনো নির্বাচিত হয়েছিলাম। নৌকা নিয়ে বিজয়ী ৫৮ সিটের মধ্যে আমার একটি ছিল। সব মিলিয়ে আমার যাত্রাটাই শুরু হয় বিরোধীদলীয় রাজনীতি দিয়ে।
বিরোধী দলে থাকাকালে অনেক নির্যাতিত হয়েছি, পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েছি, আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছি। এক-এগারোর পর ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। ১৯৭১ সালে যে লক্ষ্য সামনে রেখে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের রূপরেখা ছিল এই ইশতেহার, যা আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করে। দেশের জন্য ভালো কিছু করার প্রত্যাশায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল।
পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করে ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখলাম, দিনবদলের সনদ ছিল ভাঁওতাবাজি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেখলাম অদৃশ্য কিছু শক্তি এসে ম্যানুপুলেশনের চেষ্টা করছে। মিটিংয়ে বলেছিলাম, আজ থেকে সব বদলি বাণিজ্য বন্ধ! পুলিশ সংস্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার পথে নানা বাধা সৃষ্টি করা হয়।
শেখ হাসিনাকে শ্রদ্ধা করতাম। যদিও অনেকে আমাকে বলেছেন, হাসিনা কখনো তাজউদ্দীন আহমদের ছেলেকে ভালো চোখে দেখবেন না। এক দিন দেখলাম আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাকে সবার সামনে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘বিএনপি অনেক টাকা বানিয়েছে। এখন আমাদেরও দুই হাতে টাকা বানাতে হবে।’এটা শোনার পর তাঁর প্রতি আর বিন্দুমাত্র রেসপেক্ট থাকেনি। আরো অনেক বিষয় মিলিয়ে আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমি যখন কাজ করতে চাচ্ছিলাম তখন দেখলাম আমার কোনো নির্দেশনা ফলো হচ্ছে না। পরে জানতে পেরেছি, আমার অধীন সব কর্মকর্তাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কোনো নির্দেশনা মানা যাবে না! এই অবস্থায় পদত্যাগ ছাড়া অন্য পথ দেখিনি।
প্রশ্ন: বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে ধমক দিয়েছিলেন এমন কথা শোনা যায়...
সোহেল তাজ: বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় মেয়ের জন্মদিন উদযাপনে আমি আমেরিকা ছিলাম। ১৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা চলে যাই। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাকাণ্ডকালে এক আত্মীয়ের মারফত জানতে পারি, পিলখানায় গোলাগুলি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলাম তৎকালীন আইজি নুর মোহাম্মদকে। পরিস্থিতি শুনে রেসকিউ ফোর্স পাঠাতে বললাম। পুলিশ, র্যাবসহ সব ফোর্সকে গেদার করার অনুরোধ করলাম। আইজি বললেন, এ রকম কোনো নির্দেশনা পাইনি। এখানে মন্ত্রী মহোদয় আছেন। তার মানে আমি প্রতিমন্ত্রী, ওখানে মন্ত্রী আছেন। আমি বুঝলাম, আইজি আমার ইনস্ট্রাকশন ফলো করতে পারছেন না। ফোন করলাম মন্ত্রী মহোদয়কে। উনি বললেন, বিষয়টা প্রধানমন্ত্রী দেখছেন! তাৎক্ষণিকভাবে আমি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে একই কথা বললাম! তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমেরিকায় বসে এত বোঝার দরকার নেই, আমি দেখছি।’
আমাকে ঘিরে বিডিআর ইস্যুতে একটা অপপ্রচার চলে, আমি নাকি হত্যাকারীদের পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি! প্রশ্ন করতে চাই, কীভাবে করলাম সেটা? হত্যাকারীরা কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল? আমি তো দেশে এসেছি ১০ মার্চ।
ঘটনার অনুসন্ধানে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বিডিআর ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু আমাদের হাত থেকে সব কিছু সরিয়ে নিয়ে কোঅর্ডিনেটিং ফরম্যাট করে দেওয়া হলো! কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে। তারাই সমস্ত কিছু তদন্তের দায়িত্ব নিলেন। আমাদের কোনো কিছুতে ইনভলভ রাখা হয়নি। এটাও আমার কাছে খটকা লেগেছে।
প্রশ্ন: পদত্যাগ করার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে ফোনে গান শুনিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। আসলে কী হয়েছিল?
সোহেল তাজ: ‘আমি ৩১ মে প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। সংবিধানের ৫৭ ধারা অনুযায়ী একজন মন্ত্রী যখন পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করবেন তখনই পদত্যাগ চূড়ান্ত হয়ে যায়। উনি পদত্যাগপত্র নিতে চাইছিলেন না। আমেরিকা গিয়ে সেখান থেকেই তাকে ফোনে বললাম, আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ ও কার্যকর করুন।’ তখন আমাকে নানা অফার করা হয়েছে, দলীয় পদ-পদবি দিতে চাইলেন। রাজি হইনি। এক পর্যায়ে ফোনেই উনি গান গাওয়া শুরু করলেন। আমি হতবাক হয়ে যাই। গানটা ছিল এমন—‘আমি কাউকে ছাড়ি না, আমি তোমাকে ছাড়ব না।’ এই গান তিনি দুই মিনিট ধরে রিপিট করলেন। বুঝে উঠতে পারছিলাম না দেশের প্রধানমন্ত্রী ফোনে গান গাইছেন আবার গানের সুর এ রকম—আমি তোমাকে ছাড়ব না, আমি কাউকে ছাড়ি না! কি ভয়ংকর অবস্থা! তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাহেবের একটা ডায়ালগ মনে পড়ল, ‘বাঘে ধরলেও ছাড়ে; শেখ হাসিনা যারে ধরে তারে ছাড়ে না!’ শেখ হাসিনার এই থ্রেট আমি কীভাবে গ্রহণ করব, তা বুঝতে পারছিলাম না। এটা ভয়াবহ একটা ব্যাপার ছিল। এরপর কার্যত দুই-তিন বছর আর আমি দেশে ফিরিনি!
পরবর্তী সময়ে আমি বাধ্য হলাম সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করতে। সব মিলিয়ে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য ছিলাম। তখন আমি যেটা দেখেছি, দলকে পরিচালনা করেছে ডিজিএফআই। দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের রিপোর্ট করতে হতো ডিজিএফআইয়ের কাছে। এটা আমাকে হতাশ করেছিল। একটা গণতান্ত্রিক দল, যে দল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই দল পরিচালিত হচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা। এই দলের তো আর কিছুই রইল না তাহলে।
প্রশ্ন: আপনি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতি থেকে দূরে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে কেন সরে গেলেন?
সোহেল তাজ: আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে মূলত সরে গেছি, কারণ— আমি যে আওয়ামী লীগকে জানতাম, চিনতাম, যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমি ইতিহাসে পড়েছি। সেই আওয়ামী লীগ এবং বর্তমানের আওয়ামী লীগের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। দেশের আপামর জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী ছিল? আজ যে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করেছে এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যেখানে সাম্য থাকবে, মানবাধিকার থাকবে, মেধাভিত্তিক সমাজ, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিরাপদে বাস করবে, সবার বাকস্বাধীনতা থাকবে, একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হবে। সেই বাংলাদেশের জন্যই কিন্তু আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। সেটাই ছিল আওয়ামী লীগের সত্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগ আজ রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। সুবিধাবাদী-লোভীরা ধনসম্পদ বানানোর জন্য এই সংগঠনটাকে তছনছ করে ফেলেছে।
এই যে হত্যা, গুম, খুন এবং অপরাজনীতি; এই সংস্কৃতিকে একটা আতঙ্কে পরিণত করা হয়েছিল যে ‘মানুষ গুম হয়ে যায়, মানুষ নাই হয়ে যায়’। আমার নিজের ভাগিনাকে ১১ দিন আয়নাঘরে আটকে রেখেছিল। তখন আয়নাঘর নামটা আমরা জানতাম না। ব্যক্তিগত ঘটনায় একটা প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে আমার ভাগিনাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এটা চিন্তা করা যায়! রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যক্তিগত কাজে! এই বাংলাদেশ আমরা কোনো দিন চাইনি।
প্রশ্ন: সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের এমন শোচনীয় অবস্থা কেন?
সোহেল তাজ: একটি গণতান্ত্রিক দল যখন তার সত্তা হারিয়ে ফেলে, যখন দলের নেতাকর্মীদের মূল উদ্দেশ্যই হয় লুটপাট করা, টাকা-পয়সা কামানো, নির্বাচন ধ্বংস করা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করা। তাহলে এটা কাদের দল? সহজ উত্তর— এটা লুটেরাদের দল। আর লুটেরাদের পতন অনিবার্য, তাদের বিচার হবে। আর এটা তারা জানে বলেই আজ তারা নেই, তারা পালিয়ে আছে। নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। সেটাকে ধ্বংস করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। গত তিনটা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি মানুষ। ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন। যেখানে ১৫১ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন ছিল রাতের ভোটের নির্বাচন। সর্বশেষ নির্বাচন ছিল ডামির নির্বাচন। এটা তো বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা! আওয়ামী লীগ নামধারী এই রাক্ষস দল হত্যা, খুন, গুম, কায়েম করেছে। শেখ হাসিনা নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন, লুট করেছেন, দুর্নীতি করে লাখ লাখ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন, গুম-খুন করেছেন। দুই-চারটা ব্রিজ আর মেট্রো রেল দেখিয়ে লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছেন। দুর্নীতিকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেটা বাংলাদেশে কখনো হয়নি। দেশের বিচারব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছেন। এত এত অন্যায় করেছেন, এটার জবাব দিতে হবে না?
প্রশ্ন: অবস্থা বেগতিক দেখে শেখ হাসিনা এক প্রকার পালিয়ে গেছেন। এই বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
সোহেল তাজ: দেখেন এখানে যদি একটা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকত, সুষ্ঠু নির্বাচন হতো, দুর্নীতি না হতো এবং হত্যাযজ্ঞগুলো না হতো তাহলে তিনি এখানেই থাকতেন। এত অনিয়ম করে তার পক্ষে দেশে থাকা সম্ভব ছিল না।
প্রশ্ন: সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে আওয়ামী লীগের করণীয় কী?
সোহেল তাজ: আওয়ামী লীগের প্রথম কাজ যেটা করতে হবে— আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনা। পাশাপাশি যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের দল থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। দলকে হায়েনাদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। তারপর আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রা শুরু হবে। আগে আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা ভাইরাসগুলো সরাতে হবে। দলটির মধ্যে যারা ভালো মানুষ, যারা কোনো অন্যায় অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নন, তাদের জেগে উঠতে হবে।
প্রশ্ন : দলের এই সংকটে যদি আপনাকে দায়িত্ব নিতে হয় বা তৃণমূল যদি আপনাকে চায় সে ক্ষেত্রে কী করবেন?
সোহেল তাজ: বর্তমানে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা হলো মানুষের লাইফস্টাইল নিয়ে কাজ করব। আমার মতে, এটা অত্যন্ত মহৎ কাজ। স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছি। এসব নিয়েই আমি ব্যস্ত। ভবিষ্যতে যদি কখনো এমন সুযোগ হয় বা এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে বিবেচনা করতে পারি। তবে এই মুহূর্তে রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা নেই।
প্রশ্ন: ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হয়েছে। প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আপনার কাছে একটু শুনতে চাই।
সোহেল তাজ: বিষয়টাকে আমি এভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই—একটা পাতিল যেখানে পানি ফুটছে। এই পানিটা মনে করেন দেশের জনগণ। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত নানা ধরনের চাপের মধ্যেও আমরা ফুটছি। আর সরকার হচ্ছে পাতিলের নিচে থাকা আগুন। সরকার কতটুকু হিট দেবে সেই আগুনে সেটার ভিত্তিতে মানুষ জ্বলে ওঠে। এই অবস্থার মধ্যেই নির্বাচন চলে আসে, তখন জনগণ সিদ্ধান্ত নেয়, এই সরকার রাখবে নাকি নতুন সরকার আনবে। বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে যেটা হয়েছে পাতিলের তলায় এই যে আগুন সেটা ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পানি ফুটছে তো ফুটছে এবং ঢাকনাটা চাপ দিয়ে ধরে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে পানিটা ফুটতে ফুটতে এমন একটা জায়গায় এসেছে যেটা বিস্ফোরণের জন্য একেবারে রেডি ছিল। পাশাপাশি গত ১৫ বছর বিরোধী দলের ওপর দমন-নিপীড়ন, জেল-জুলুম, গুম-খুন এসব অত্যাচার যোগ হয়। দেশের লাগামহীন দুর্নীতি, টাকাপাচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি—সব মিলিয়ে জনগণ ছিল একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়। বর্তমান জেনারেশনের অনেককে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন থেকে লাঠিপেটা করে দমন-পীড়ন করা হলো। সব কিছু মিলিয়ে দুই-তিন জেনারেশন এই ফুটন্ত পানির মধ্যে জ্বলছে। এই জেনারেশনই সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। একটা ইন্টারভিউতে সরকার প্রধান আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বললেন। জবাবে ছাত্র-জনতা বলল, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ কয়েকটা জেনারেশনকে এভাবে প্রশাসনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। তারপর বলা হলো, এই ছাত্রদের মোকাবেলা করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট! রংপুরে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ছোট্ট ছেলে আজাদ, ছোট্ট মেয়ে রিয়াসহ শত শত মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলা হলো।
প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার তথা ড. ইউনূস সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা?
সোহেল তাজ: ড. ইউনূস সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররা, আর সম্পৃক্ত ছিল সাধারণ জনতা। পাশাপাশি বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলোও অংশ নিয়েছে। আমরা এমন একটা বাংলাদেশ চাই, যে বাংলাদেশে বৈষম্য থাকবে না, যেখানে সবার বাকস্বাধীনতা থাকবে, মানুষের মানবাধিকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে। এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখবে। তবে যুগ যুগ ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করায় সুস্থ ধারায় ফিরতে আমাদের সময় লাগবে।
প্রশ্ন: বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের কথা বলছে। আপনার মতে ঠিক কত দিন পর নির্বাচন হওয়া উচিত?
সোহেল তাজ: আমার মতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে পুনর্নির্মাণ করে কার্যকর করতে হবে। তারপর আমরা নির্বাচনের কথা ভাবতে পারব। অবশ্যই চাই গণতান্ত্রিক ধারায় বাংলাদেশ ফিরে আসুক। এখানে আনলিমিটেড টাইম তো হতে পারে না কিন্তু যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সময় এই সরকারকে দিতে হবে। সেটা হয়তো ছয় মাস কিংবা এক বছরে হবে না। তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা আমরা সবাই চাই।
সূত্র-কালের কণ্ঠ
আইএ