• ঢাকা
  • শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
রাজধানীর খাল উদ্ধার অভিযান শুরু

চার নদীতে মিলবে ২৬ খাল


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ৩, ২০২১, ০৩:২১ পিএম
চার নদীতে মিলবে ২৬ খাল

ঢাকা : স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রভাবশালীদের দখলে হারিয়ে গেছে রাজধানীর বেশিরভাগ খাল। তবে রাজধানীকে বাঁচাতে ও খালগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, এখন উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ঢাকার দুই নগরপিতা। আগামী জুন মাসের মধ্যেই রাজধানীর ২৬টি খাল আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করে দিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ।

এদিকে কোনো শক্তির সঙ্গে আপস নয়, যে কোনো মূল্যে খালগুলো উদ্ধার করে পানিপ্রবাহ ঠিক করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ঢাকার দুই মেয়র।

অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, যদিও কাজটি সহজ নয়, তবে এই জাতীয় উদ্যোগ কিছুটা হলেও খালগুলো রক্ষায় বেশ ভূমিকা রাখবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সম্প্রতি ঢাকার খালগুলোর অতীত-বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে এক বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে, যাতে এই মহানগরের বুক থেকে অধিকাংশ খাল হারিয়ে যাওয়ার এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।

ঢাকা মহানগরের ভূমি প্রশাসনের মোট ১১টি সার্কেলের মধ্যে ছয়টি সার্কেলের অতীতের ভূমি জরিপ, মানচিত্র ও অন্যান্য নথিপত্র বিশ্লেষণ করে নদী রক্ষা কমিশন মোট ৬৫টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে। তাহলে অনুমান করা যায় যে অবশিষ্ট পাঁচটি সার্কেলের অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে নিশ্চয়ই আরো প্রায় সমানসংখ্যক খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর গবেষণা সূত্র জানায়, ঢাকা জেলা প্রশাসনের হিসাবে ঢাকায় খালের সংখ্যা ৫৮টি। এর মধ্যে ৩২টি খালের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। যে কটি টিকে আছে সেগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নেই। নদীর সঙ্গে সংযোগও প্রায় কাটা পড়ছে। জলাবদ্ধ হয়ে পরিণতি ভোগ করছে ঢাকার পৌনে দুই কোটি মানুষ। তাই অস্তিত্বে থাকা বাকি ২৬টি খাল অবৈধ দখল মুক্ত করে এখনো সচল করা সম্ভব।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর ৩৭টি খালের অংশবিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর খালের মধ্যে একমাত্র ধোলাইখালের একটা অংশ (সূত্রাপুর লোহারপুল থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত) ও মেরাদিয়া খাল সচল আছে। বাকি সব কটি খালের জায়গায় এখন রাস্তা। প্রতিবেদনে এমনটা বলা হলেও নন্দীপাড়া খাল এখনো সচল আছে। প্রবাহ আছে কুতুবখালী খালেও। যে খালগুলো এখনো টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশ ময়লা-আবর্জনার চাপে স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে পারছে না। দ্রুত উদ্ধার না করলে সেগুলোও হারিয়ে যাবে।

মিরপুর সার্কেলের বাউনিয়া খালের একাংশ ভরাট করে ফেলেছে রাজউক। একইভাবে আবদুল্লাহপুর খাল এবং দিয়াবাড়ি খালের কিছু অংশও ভরাট করেছে সংস্থাটি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিয়াবাড়ি খালের ভরাট অংশ রাজউকের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ঢুকে গেছে। রামচন্দ্রপুর খালের জায়গা দখল করেছে বেশ কটি আবাসন প্রতিষ্ঠান।

এগুলো হলো নবীনগর হাউজিং, জেমকন সিটি, মোহাম্মদী হাউজিং, রাজধানী উদ্যান। অবৈধ দখলে হারিয়ে গেছে-ভাটারা, ডুমনী, বোয়ালিয়া ও জোয়ারসাহারা-কাঠালদিয়া খাল। এর মধ্য ডুমনি খালটি পুরোপুরি অচল। বোয়ালিয়া খালের আরেক দখলদার বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি। ৩০০ ফুট রাস্তার সেতু থেকে খিলক্ষেত ইছাপুরা রাস্তার সেতু পর্যন্ত দুই পাশ দখল করেছে তারা।

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ঢাকার সব খালের মালিকানা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত খুবই ভালো উদ্যোগ। এখন খালের মালিকানা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ঠেলাঠেলি থাকবে না।

তবে প্রভাবশালীরা যে ভাবে খালগুলো গ্রাস করেছে, সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে তা দখল মুক্ত করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সর্ব স্তরের সমন্বিত উদ্যোগ।  

নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন,  তিন যুগে রাজধানীর এসব খাল-জলাভূমির অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। এখন সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে ঢাকার রাস্তাঘাট। তাই ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে যে কোনো উপায়ে ঢাকার খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। পানিপ্রবাহের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। না হলে এই শহরকে কেউ আর রক্ষা করতে পারবে না।

নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, অবৈধ দখল হয়ে যাওয়া উদ্ধার করা কাজটি যদিও সহজ নয়। তবে সিটি করপোরেশনের মালিকানায় খালগুলো আসায় এর রক্ষাণাবেক্ষণ ভালো হবে। কিন্তু এ কাজে সফল হওয়ার জন্য, দীর্ঘমেয়াদি নগর পরিকল্পনা, সামাজিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস একই কথা বলেছেন যে, খাল দখল মুক্তকরণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ২ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হয়ে গেছে। এখন খালগুলোর পানিপ্রবাহ সৃষ্টি করতে অবৈধ দখল মুক্ত করতে ক্রাশ অভিযান শুরু হবে। আগামী জুন মাসের মধ্যেই সব খাল উদ্ধার করে ঢাকার চারপাশের প্রধান চার নদীতে (বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা) যুক্ত করা হবে।

কোন খাল কোন নদীতে সংযুক্ত হবে : সোয়া পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালটি কল্যাণপুর খাল হয়ে যুক্ত হবে তুরাগে। গাবতলী, দারুসসালাম, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আদাবর, পীরেরবাগ, আগারগাঁও তালতলা, শেওড়াপাড়ার একাংশ, মাজার রোড, আনসার ক্যাম্প, লালকুঠি, টোলারবাগ, পাইকপাড়া, আহমেদাবাদ, শাহআলী বাগ, বড়বাগ, মণিপুর, মিরপুর-১, ২, ৬, ১১, ১২ নম্বর আবাসিক এলাকা, রূপনগর ও জাতীয় চিড়িয়াখানা এলাকার এ খালটিও তুরাগে যুক্ত হবে।

মিরপুরের বাউনিয়া খালের সঙ্গে মিরপুরের সাংবাদিক কলোনি খাল, বাইশটেকি খাল ও মিরপুর হাউজিং এলাকার খালগুলো সংযুক্ত। সব মিলে এটি ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ লম্বা। দখলের কারণে বর্তমানে এই খালগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এগুলোকে যুক্ত করে মিরপুরের পল্লবী, কালশী, মিরপুর ১০ নম্বর, ১৩ ও ১৪ নম্বর এবং মিরপুর ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার সব নিষ্কাশন নালা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তুরাগে মিলবে।

উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকার সব নিষ্কাশন নালা যুক্ত হয়েছে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে। খালটি উত্তরার কাছে টঙ্গী খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু তা এখন বিচ্ছিন্ন। আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে টঙ্গী খালের সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।

ঢাকার এক সময়কার অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি এলাকার সব নিষ্কাশন নালার পানি ধানমন্ডি লেক হয়ে হাতিরঝিলে গিয়ে পড়ত। কিন্তু পান্থপথ সড়ক নির্মাণের সময় ধানমন্ডি লেক ও হাতিরঝিল বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযোগ হবে বালু নদীর।

পুরান ঢাকা, জিরানী, মান্ডা, মেরাদিয়া-গজারিয়া, কসাইবাড়ি, শাহজাহানপুর, শাহজাদপুর, সুতিভোলা, ডুমনি, বোয়ালিয়া, রামপুরা, গোবিন্দপুর, সেগুনবাগিচা ও খিলগাঁও-বাসাবো খালগুলো সুবিধা মতো মিলবে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!