ঢাকা : পুরো রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। অলিগলি থেকে শুরু করে মূল রাস্তাতে এসব রিকশার দাপট থাকলেও নিষিদ্ধ এ বাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপটের পেছনে রয়েছে নীরব চাঁদাবাজি। প্রতি মাসে এসব রিকশা থেকে কোটি কোটি চাঁদাবাজি হচ্ছে। বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে স্থানীয় নেতা ও প্রশাসন ম্যানেজ করে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।
সূত্রমতে, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বরং দিন দিন এগুলোর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে যানজট, ভোগান্তি। এমনকি চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। গত শনিবার রাতে রাজধানীর পল্লবীতে এ নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। কাউন্সিলরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রিকশাগুলোর ব্যাটারি খুলে নেওয়ার ঘটনায় চালকরা সংঘবদ্ধ হয়ে কাউন্সিলরের ওপর হামলা করলে তিনি মসজিদে আশ্রয় নেন। এতে ক্ষুব্ধ চালকদের রোষানাল থেকে কোনমতে রক্ষা পান। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
মোটরচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের নির্দেশনা : সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব ব্যাটারি বা মোটরচালিত রিকশা ও ভ্যান চলছে তা বন্ধের নির্দেশনা দেয় সরকার। গত ২০ জুন এ সিদ্ধান্ত হয়। সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখেছি সারা দেশে রিকশায় মোটর লাগিয়ে চলছে। সেগুলোর সামনে ব্রেক থাকলেও পেছনে ব্রেক নেই। যখন ব্রেক করে তখন যাত্রীসহ সবাই উল্টে পরে দুর্ঘটনা ঘটে। এখন থেকে সারা দেশে এই ধরনের রিকশা চলতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্দেশনা দেবে।
জানা যায়, যানজটের নগরী ঢাকার ব্যস্ততম রাস্তা দখল করে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (অটোরিকশা) ও ফিটনেসবিহীন লেগুনার স্ট্যান্ড। ফলে তীব্র যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন পথচারীরা। অপরদিকে এসব যানবাহনকে পুঁজি করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পুলিশ দৈনিক লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর শ্যামপুর, কদমতলী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, দারুস সালাম, কাফরুল, পল্লবী, উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, খিলগাঁও, সবুজবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, তুরাগ, হাজারীবাগ, আদাবর থানা এলাকার অলিগলিতে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। পুলিশের চোখের সামনেই এগুলো দেদার চলাচল করছে, অহরহ যানজট বাঁধাচ্ছে। এছাড়া প্রায়ই ঘটাচ্ছে দুর্ঘটনা। তবুও নিষিদ্ধ এ যানবাহনগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বিআরটিএর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জনবলের অভাবে রাজধানীর সব এলাকায় এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তারপরও বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্টের অভিযানে বহু অটোরিকশার মোটর খুলে ফেলা এবং অনেক ইজিবাইক ডাম্পিংয়ে পাঠানোর দাবি করেন ওই কর্মকর্তা। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি রাস্তা, অলিগলি সয়লাব হয়ে পড়ছে নিষিদ্ধ অটো-ইজিবাইকে।
জানা যায়, রাজধানীর সর্বত্রই মোটা অঙ্কের চাঁদার বিনিময়ে অবৈধ এ যান চলাচলের মৌখিক বৈধতা দিচ্ছে পুলিশ। কোনো কোনো এলাকায় প্রতিদিন নামানো হচ্ছে ৪০-৫০টি নতুন অটো-ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে নিত্যনতুন রুট বানিয়ে শত শত নিষিদ্ধ যানের ভিড়-ভাড়াক্কা গড়ে তোলা হচ্ছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, কদমতলী থানার দনিয়া এলাকাতে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রায় এক হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা নামিয়েছে একটি চোরাই সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকা থেকে রিকশা চুরি করে এনে দনিয়া এলাকার বিভিন্ন রিকশার গ্যারেজে রেখে সেগুলোর রঙ পরিবর্তন করে ব্যাটারি লাগিয়ে রাস্তায় নামায়।
রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় তিনটি রুটেই চলাচল করছে সহস্রাধিক ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এ রুটগুলো হচ্ছে বিমানবন্দর রেললাইন থেকে দক্ষিণখান, তালতলা, কসাইবাড়ি থেকে দক্ষিণখান বাজার, কসাইবাড়ি থেকে কাঁচকুড়া, হাজী ক্যাম্প থেকে কাঁচকুড়া এবং আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তরখান মাজার রোডসহ অন্যান্য পয়েন্ট।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ এলাকার প্রতিটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন ৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় হয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশের হয়ে কাজ করে স্থানীয় কয়েকটি চক্র। চাঁদার টাকা থেকে থানা পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান-সন্ত্রাসী, ট্রাফিক বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থার চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। চাঁদার টাকা না দিলে লাইনম্যান, ট্রাফিক পুলিশ ও থানা পুলিশ সেসব গাড়ি আটক করাসহ সংশ্লিষ্ট চালকদের ওপর নির্যাতন চালায়। সেখানে দক্ষিণখান ইউনিয়ন পরিষদও চাঁদাবাজিতে মোটা অঙ্কের ভাগ বসায় বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘লাইসেন্স’ দেওয়ার নামে প্রতি ইজিবাইক থেকে ইউনিয়ন পরিষদের নামে দেড় হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। হাইকোর্টের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কোন ক্ষমতাবলে ইউনিয়ন পরিষদ সেসব যান চালাচলের লাইসেন্স দেয়, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
উত্তরা ৪ নং ও ৮ নং সেক্টরের আবহাওয়া কোয়ার্টারের সামনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে প্রায় পাঁচ শতাধিক ইজিবাইক নিয়ন্ত্রিত হয়। যার প্রতিটি থেকে দৈনিক ১২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ৪ নম্বর সেক্টরে শাহজালাল এভিনিউতে হাইওয়ে পুলিশের সদর দপ্তরের নিচেই ইজিবাইকের স্ট্যান্ড। এই রুটে তিন শতাধিক ইজিবাইক চলে এবং এগুলো খুবই বেপরোয়া। শাহজালাল এভিনিউটি ডিভাইডার দিয়ে একদিকে চলাচলের ব্যবস্থা করা হলেও কোনো কিছুই চালকরা মানছেন না। ফলে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে আশপাশে বেশ কয়েকটি স্কুল থাকায় ইজিবাইকগুলো ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে উত্তরা, জসীমউদ্দীন রোড ও সোনারগাঁও জনপথে চলে লেগুনা। এসব লেগুনা চালকের অধিকাংশের বয়সই ১৪-১৫ বছরের ঊর্ধ্বে নয়। প্রতিটি লেগুনা থেকে হাউজবিল্ডিং এলাকায় ২০০ টাকা ও দিয়াবাড়ী এলাকায় ১২০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়াও বিমানবন্দর ট্রাফিক পুলিশ বক্সের এক কর্মকর্তা প্রতি সপ্তাহে অটোপ্রতি ১২০০ টাকা করে আদায় করে নিচ্ছে। মাসোয়ারার টাকা না পেলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ইজিবাইক পুলিশ বক্সে আটকে রেখে ডাম্পিং ও রেকার বাণিজ্য করেন। ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত অটো ও লেগুনা নামের নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে খিলক্ষেত এলাকায়। সেখানে রেলগেট মোড় থেকে ১২ শতাধিক অবৈধ যান চলাচল করছে অবাধে।
এদিকে তালতলা ও ডুমনি, বিমানবন্দর ট্রাফিক পুলিশ বক্স থেকে সিভিল এভিয়েশন কোয়ার্টার, খিলক্ষেত বাজার থেকে লেকসিটি, কসাইবাড়ি থেকে দক্ষিণখান বাজার ও ইউনিয়ন, জয়নাল মার্কেট থেকে দক্ষিণখান বাজার, আজমপুর থেকে উত্তরখান থানা এবং ময়নারটেক ও আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তর খান। এসব রুটে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ইজিবাইক এবং অটোরিকশা চলে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন ৮০-১০০ এবং প্রতি অটোরিকশা থেকে ৫০-৭০ টাকা আদায় করা হয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশের হয়ে কাজ করে ‘লাইনম্যান’ নামে স্থানীয় একটি চক্র। সহস্রাধিক অবৈধ যানববাহন থেকে প্রতিদিন আড়াই লক্ষাধিক টাকা চাঁদাবাজি চলে। চাঁদাবাজির প্রায় অর্ধেক টাকা পান স্থানীয় থানা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা।
এছাড়াও খিলগাঁও, রামপুরা এমনকি বনশ্রী আবাসিক এলাকার ভেতরের রাস্তাতে অটো রিকশার দাপট দেখা যায়। এগুলো থেকে প্রতি মাসে স্থানীয় নেতাদের মাসোহারা বা বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে চলাচল করে। তবে ঢাকার সব নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলে রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা রয়েছে বলে অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক দক্ষিণ) সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, রাজধানীর ব্যস্ততম কোনো রাস্তায় ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর সুযোগ নেই; বরং প্রতি মাসেই এসব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।
অন্যদিকে ঢাকার বাইরে অন্যান্য মহানগর, জেলা শহর এমনকি থানা সদরেও শত শত ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া দাপট রয়েছে। প্রধান প্রধান সড়ক মোড়, টার্মিনাল, বাসস্ট্যান্ডে এসব অবৈধ যানবাহনের আধিক্যতায় যানজট-দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে গাড়িগুলোর ব্যাটারি চার্জের নামে দেদার বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধ এ যানবাহনকে পুঁজি করেই চলছে চাঁদাবাজি।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :