ঢাকা : রাজধানীকে ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এর ফলে আটকে থাকতে হবে না কোনো যানজটে। একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বের হওয়া যাবে। কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে গন্তব্যে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর যা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করছে।
যানজট নিরসনে রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের যে পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার তা হলো-আউটার রিং রোড, মিডেল রিং রোড এবং ইনার রিং রোড। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে আউটার ও ইনার রিং রোড নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, আট থেকে দশ লেনবিশিষ্ট সড়কগুলো এমন হবে যে, ঢাকার ওপর দিয়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যেতে গাড়িগুলোকে দীর্ঘ সময় জটে বসে থাকতে হবে না। ঢাকার চারপাশ ঘিরে আউটার ও ইনার রিং রোড মিলিয়ে মোট ২২০ কিলোমিটার সড়ক হবে। যানজট যাতে না হয় সেজন্য এসব সড়কে ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, বাইপাসও নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়া থাকবে নানামুখী সংযোগ সড়কও।
ঢাকার যানজট কমিয়ে গাড়ির চলাচলে গতি বাড়াবে ইনার রিং রোড। এই সড়কের র্দৈঘ্য হবে ৮৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬৩ কিলোমিটার সড়ক আবদুল্লাহপুর থেকে গাবতলী, সোয়ারিঘাট হয়ে পোস্তগোলা, ডেমরা, নারায়গঞ্জ গিয়ে শেষ হবে। আর ডেমরা থেকে বালু নদের তীর ঘেঁষে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার হবে আরেকটা অংশ। এই অংশে সড়ক নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। নতুন সড়ক নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড রুট নির্ধারণের কাজ করছে। সংস্থাটি এই সড়ক নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ, স্লুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণ করে দেবে।
আর দশ লেনবিশিষ্ট সড়ক নির্মাণ করবে সওজ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে এর ৬৩ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। দুই ভাগে ভাগ করে ইনার রিং রোড প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বর্তমানে দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এখানে সড়কের পাশাপাশি অনেকগুলো ফ্লাইওভার, বাইপাস, আন্ডারপাস সার্ভিস লেন সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
পুরো ৬৩ কিলোমিটার সড়কের মাঝে হবে ছয় লেন, আর দুই পাশে হবে আরো দুই দুই করে চার লেন। ইনার রিং রোড নির্মাণ হলে এক দিক থেকে ঢুকলে সেদিক থেকেই বেরিয়ে চলে আসা যাবে। রেডিয়াল কানেকশন পাওয়া যাবে অনেকগুলো। যেমন-গাবতলী থেকে আরিচার দিকে যাওয়া যাবে।
এদিকে ভাঙা মাওয়া ফরিদপুর অনায়াসে যাওয়া যাবে। ঢাকা চট্টগ্রামে যেতে কানেকশন থাকবে সিঙ্গাইলে। আর আব্দুল্লাহপুরের সঙ্গে থাকবে গাজীপুরের কানেকশন। ধৌরে থাকবে নবীনগর, চন্দ্রার দিকে কানেকশন। একবার এই রিংরোডে উঠলে বিভিন্ন স্থানে অনায়াসে চলে যেতে পারবে গাড়িগুলো। আবার ঢোকার ক্ষেত্রেও তাই।
আউটার রিং রোড হবে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে কালাকান্দি-তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু, মদনপুর, ভুলতা হয়ে গাজীপুরের কড্ডা থেকে ঢাকা-ইপিজেড বাইপাইল দিয়ে হেমায়েতপুর পর্যন্ত। মোট ১৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা আউটার রিং রোডের ৪৮ কিলোমিটারই নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। বাকি ৮৪ কিলোমিটার বিদ্যমান সড়ককে উপযোগী করে তুলতে হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পও দুই পর্বে ভাগ করে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম পর্বে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে কেরাণীগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত আট লেনের ৪৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে বর্তমানে চার লেনের ১২ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর সঙ্গে আরো চার লেন নির্মাণ করা হবে। বাকি ৩৬ কিলোমিটার অংশ জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। আট লেন বিশিষ্ট এই আউটার রিং রোডের প্রস্থ হবে ২৪০ থেকে ৩০০ ফুট। এ অংশে দুটি রেস্ট এরিয়া, পাঁচটি ইন্টারচেঞ্জ, ছয়টি সেতু, ২০টি ওভারপাস এবং আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে।
৩৬ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণে ৩৮৪ হেক্টর জমির প্রয়োজন হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর দ্বিতীয় পর্বে ৮৪ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ এবং উন্নয়নে ব্যয় হবে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। বিদ্যমান সড়কের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটার দুই লেন এবং ৩৬ কিলোমিটার চার লেন করে রয়েছে। এই সড়কও আট লেনে উন্নীত করা হবে। এই সড়কে বর্তমানে থাকা ছোট ছোট সেতুগুলো ভেঙে আট লেন করে নির্মাণ করা হবে। আউটার রিং রোডের একটি সমীক্ষা শেষ করা হয়েছে। এখন সেটি অর্থদাতা সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন কোম্পানি (জাইকা) পর্যালোচনা করে দেখবে।
ঢাকাকে ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। এ প্রসঙ্গে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দীন খান (ঢাকা অঞ্চল) বলেন, ‘ঢাকার যানজট কমাতে আমাদের আরএসটিপিতে ইনার রিং রোড, মিডল রিং রোড এবং আউটার রিং রোড নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। মূলত আমরা ইনার রিং রোড এবং আউটার রিংরোড নিয়েই কাজ করছি। ইনার রিংরোড হবে মোট ৮৮ কিলোমিটার। দুই ধাপে আমরা কাজ শুরু করেছি। কারণ ৬৩ কিলোমিটার সড়ক এখন তৈরি আছে, যেটি বাড়াতে হবে আরো ২৫ কিলোমিটার।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এখানে ভূমি অধিগ্রহণ অতটা লাগবে না। অল্প কিছু লাগবে। সেটা নিয়ে সড়ক ও জনপথ কাজ করছে। সেখানে সমীক্ষা, নকশা শেষ। এখানে অনেকগুলো ফ্লাইওভার, বাইপাস, আন্ডারপাস সার্ভিস লেন সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সোয়ারিঘাট থেকে সদরঘাট যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ ওখানে জমি নেই। সেজন্য সোয়ারিঘাট পার হয়ে বুড়িগঙ্গা ক্রস করে ওপার চলে যাবে গাড়িগুলো। ওপারে গিয়ে বাবুবাজার সেতুর পাশে আরেকটা আট লেনের সেতুর প্রস্তাব করা হয়েছে। সেটি কদমতলী চুলকুটিয়া হয়ে পোস্তগোলা (সেখানেও একটা নতুন সেতু তৈরি হবে চার লেনের) হয়ে চলে যাবে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায়। এটি হলো আমাদের অ্যালাইনমেন্ট পার্ট-২। যেটি ৬৩ কিলোমটার দৈর্ঘ্যের। যেখানে ব্যয় হবে ১২ হাজার কোটি টাকা।’
তিনি জানান, এই প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছে তিন বছর আগে। যে কারণে ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অর্থদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি এবং তাদের সম্মতিপত্র পেয়েছি। এখন তারা রিভিউ করবে। এর পর তারা দেখবে, সমীক্ষা ঠিক আছে কি না।’
ব্যয় বৃদ্ধির কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সমীক্ষা শেষ হয়ে প্রায় চার বছর আগে। এর মধ্যে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। সে জন্য এখন ব্যয় বাড়বে। দেরি হওয়ার কারণ এশিয়ান ইনফ্রাকস্ট্রার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। তাদের অর্থায়নের কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ শুরু হওয়ায় সেটির প্রস্তাব আর এগোয়নি। চীনে যখন করোনা শুরু হয় তখনই প্রস্তাবটা যায় সেখানে। আর এজন্য চীনের দাতাসংস্থা দেরি করায় কাজ শুরুতে বিলম্ব হয়। তবে সম্প্রতি তারা সম্মতিপত্র দিয়েছে।’
আউটার রিং রোডের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটিরও সমীক্ষা শেষ হয়েছে। বলা যায়, এটির কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা বাইপাস যেটি গাজীপুরের কড্ডা থেকে শুরু হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত চলে গেছে। এখানেও ৪৮ কিলোমিটার সড়ক পুরোপুরি নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। আর এতে প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এটি জিটুজি পদ্ধতিতে অর্থায়ন করার কথা রয়েছে।’
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :