• ঢাকা
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

ছোট্ট হোসেনের তলপেট ছেদ করে বেরিয়ে যায় গুলি


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ২৭, ২০২৪, ০১:৪৮ পিএম
ছোট্ট হোসেনের তলপেট ছেদ করে বেরিয়ে যায় গুলি

নিহত হোসেন মিয়া পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট ফেরি করত। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা : সরকারি চাকুরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে সারাদেশ জুড়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত ২০ জুলাই দুপুরবেলা রাজধানীর চিটাগাং রোড এলাকায় গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলছিল। এমন পরিস্থিতিতে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট ফেরি করে বিক্রি করা ১০ বছরে হোসেন বাসা থেকে বাইরে বেন হন। আর সে সময় একটি গুলি এসে তার তলপেট ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। গুলিতে নিহত হন হোসেন।

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যায়ও হোসেন বাসায় না ফেরায় খোঁজ শুরু করে তার পরিবার। বাবা মানিক মিয়া সন্তানের খোঁজে বের হন। কোথাও নেই। চিটাগাং রোডসহ আশপাশের এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হদিস মেলেনি হোসেনের।

এরপর রাত নয়টার দিকে কেউ একজন এসে মুঠোফোনে হোসেনের ছবি দেখান। মানিক ও মালেকা সন্তানের আহত অবস্থার ছবি দেখে চিনতে পারেন। তাঁরা জানতে পারেন, হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জনমানব ও যানবাহন শূণ্য কারফিউর ঢাকার রাস্তা পাড়ি দিয়ে বহু কষ্টে তারা ঢামেকে পৌঁছায়।

তবে ঢাকা মেডিকেলের সব জায়গা খুঁজে হোসেনকে পেলেন না। চিকিৎসকদের কাছে গেলে তারা বলেন, চিটাগাং রোড এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ অনেককেই আনা হয়েছে। আহত সবার চিকিৎসা চলছে।

দিবাগত রাত দুইটা পর্যন্ত চিকিৎসা চলছে ভেবে স্বামী-স্ত্রী বসে ছিলেন। এ সময় একজন এসে জিজ্ঞাসা করেন, তারা কেন এখানে বসে আছেন? পরে নিজের সন্তানের কথা বলেন। এ সময় লোকটা তাঁদের লাশঘরের কাছে নিয়ে যান। অনেকগুলো মরদেহের সঙ্গে ছোট্ট হোসেনের মরদেহ দেখে বাবা মানিক মিয়া জ্ঞান হারান। মা মালেকা বেগমের চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকা মেডিকেলের পরিবেশ।

জানা গেছে, হোসেনের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বরশল গ্রামে। তবে সেখানে কেউ নেই। তার বাবা মানিক মিয়া থাকেন হোসেনের মামাবাড়িতে। তারা চিটাগাং রোড মুক্তিনগর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। নিহত হোসেন ঘরের বড় ছেলে। সে আইসক্রিম চকলেট ফেরি করত। তার মাহিনুর আক্তার (৮) ও শাহিনুর আক্তার (৬) নামের ছোট দুই বোন রয়েছে।

গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর হোসেনের মরদেহ ২২ জুলাই রাত দুইটার দিকে নানাবাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বারের রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামে দাফন করা হয়েছে।

নিহত হোসেনের মামা মোস্তফা কামাল এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, হোসেনদের পরিবার ঢাকায় থাকলেও তারার তেমন কিছু নাই। বাপ-পুতে ফেরি কইয়া যা পায়, তা দিয়ে তারার সংসারডা চলত। যহন হুনলাম হোসেনের লাশ লইয়া আইতাছে, আমডা কয়েকজন মিল্যা কাফনের কাফন কিনছি। দোকান বন্ধ আছিল। দোকানদাররে বাইত (বাড়ি) যাইয়া অনুরোধ করছি। তারপর কাফনের কাফড় আরও কিছু লইয়া আইছি। কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ কবর খুঁড়ছে। সোমবার রাইত ২টার দিকে জানাজা দিয়া এরপর তারে কবর দিছি। পোলাডারে হারাইয়া বাপডা প্রতিদিন একবার বেহুঁশ হয়।

নিহত হোসেনের বাবা মানিক মিয়া বলেন,  হাসপাতালে পোলার লাশ দেহনের পর আমার আর বাইচ্চা থাহনের ইচ্ছা অয় না। আমার এইটুকু একটা পোলা। তার শইলে দুইডা গুলি লাগছে। একটা গুলি তার তলপেট দিয়া ডুইক্কা আরেক দিক দিয়া বাইর অইচে, আরেকটা তার কোমরে ডুইক্কা গেছে। আমার পোলাডা কত কষ্ট না জানি পাইছে। আল্লাহ আমার পোলাডারে কেন লইয়া গেলা।

ছেলের ছবি দেখে চিৎকার করে ছেলেকে ডাকেন মা মালেকা বেগম। মালেকা বলেন, হোসেন রে, একবার মা কইয়া ডাক দে, আমার কইলজা ঠান্ডা হইক।

একটু শান্ত হয়ে মালেকা বেগম আবার বলেন, হেদিন আমার শইলডা ভালো আছিলো না। পোলা কয়, পপকন–আইসক্রিম বেইচ্চা যেই টাকা পাইবো, এই টাকা দিয়া আমার চিকিৎসা করাইবো। আমার পোলা আর ফিরা আইলো না।

এ বিষয়ে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, তিনি ঘটনাটি জানেন না। তিনি প্রতিবেদকের কাছ থেকে নিহত হোসেনের বিস্তারিত পরিচয় নেন। এরপর বলেন, পরিবারটির জন্য সম্ভব সব রকমের সহযোগিতা করার জন্য তিনি দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) নির্দেশ দেবেন।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!