• ঢাকা
  • রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১

দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার সহজ উপায়


মুফতি নাঈম কাসেমি ডিসেম্বর ২২, ২০২০, ০৮:০০ পিএম
দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার সহজ উপায়

ঢাকা : আদিকাল থেকেই পৃথিবীব্যাপী মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকভাবে যৌথ পরিবারব্যবস্থা চালু আছে। বিশেষত পাক-ভারত উপমহাদেশে এ ব্যবস্থাই সর্বাধিক প্রচলিত। সাধারণত একটি পরিবারে স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোন এমনকী দাদা-দাদি মিলে একত্রে বাস করে থাকে। মুসলিমগণ বিবাহের পর স্ত্রীকে পেয়ে বিধর্মীদের মতো মা-বাবাকে ভুলে যায় না। বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয় না। পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরম যত্নের সাথে আমৃত্যু অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবার সেবাযত্ন করে যায়। মূলত ইসলাম ধর্মই মুসলমানদের এ মানবিকতা শিক্ষা দিয়েছে। আর পারিবারিক বন্ধন ও অনুশাসনের কারণেই বর্তমান নৈতিক অবক্ষয়ের যুগেও মুসলমানদের মধ্যে শৃঙ্খলা, পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সমপ্রীতি এবং নৈতিক মূল্যবোধ বহাল রয়েছে।

তবে যৌথ পরিবারব্যবস্থায় মাঝেমধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে সদস্যদের মাঝে কলহ-বিবাদ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি বিষয় হলো, পরিবারে স্ত্রীর কাজকর্মের পরিমাণ ও পরিধি নিয়ে। অনেকে বিয়ের পর স্ত্রীকে ঘরে এনেই মনে করে যে, এখন থেকে স্ত্রীই পরিবারের প্রয়োজনীয় সব কাজকর্ম আঞ্জাম দেবে। ঘরের রান্নাবান্না, ঘরগোছানো, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্ন, দেবর-ননদসহ সবার কাজের জন্যই যেন তাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। এসব কাজের কোনোটিতে স্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি হলে তার ওপর আপত্তি করা হয়। অনেক সময় এ নিয়ে বড় ধরনের ঝগড়াও সৃষ্টি হয়। এহেন অবস্থায় অনেকের কাছেই একটা বিষয় অস্পষ্ট। স্ত্রীর জন্য শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত ও সেবাযত্ন করা কি জরুরি? আর দেবর ও ননদদের সেবা করাও কি স্ত্রীর দায়িত্বের মধ্যে পরে?

মা-বাবার খেদমত ও সেবা-যত্ন করা মূলত সন্তানের ওপরই ওয়াজিব। এটা সন্তানের প্রতি শরিয়তকর্তৃক আরোপিত আবশ্যিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ-দেবরের সেবাযত্ন করা এবং তাদের জন্য রান্নাবান্না করা গৃহবধূর ওপর আবশ্যক নয়; বরং স্বামীরই কর্তব্য নিজের মা-বাবা ও ছোট ভাই-বোনদের সেবাযত্ন ও দেখাশোনা করা। কোনো কারণে তাদের খেদমত ও সেবাযত্ন করা সম্ভব না হলে কাজের লোক নিয়োগ করে হলেও তাদের খেদমতের ব্যবস্থা করা তার দায়িত্ব।

তবে স্বামীকে যেহেতু স্ত্রী-সন্তানের জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে কাজকর্ম করতে হয় তাই স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা ও সদাচারের দাবি এই যে, স্ত্রী স্বেচ্ছায় যতটুকু সম্ভব শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করবে। তাদেরকে আপন পিতা-মাতার ন্যায় মনে করবে। তাদের জন্য কিছু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করাকে নিজের জন্য সৌভাগ্য ও পুণ্যের কাজ মনে করবে। আর স্বামীর ছোট ভাই-বোনদের যথাসম্ভব আদরযত্ন করবে। এটা স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর ওপর ইহসান ও অনুগ্রহ হিসেবে গণ্য হবে। যার পূর্ণ প্রতিদান সে আখেরাতে লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।

সাহাবাযুগেও স্ত্রীকর্তৃক শ্বশুর-শাশুড়ি ও ছোট্ট ননদদের সেবাযত্ন করার প্রচলন ছিল বলে হাদিস শরিফে প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে দুটি হাদিস উল্লেখ করা হলো।

১. কাবশা বিনতে কাব ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি হজরত আবু কাতাদা (রা.)-এর পুত্রবধূ ছিলেন। একদা আবু কাতাদা (রা.) তার কাছে এলেন। কাবশা (রা.) বলেন, আমি তাঁর জন্য অজুর পানি প্রস্তুত করে দিলাম। এমন সময় একটি বিড়াল এসে পানি পান করতে শুরু করল। আবু কাতাদা বিড়ালটির জন্য পানির পাত্র কাত করে ধরলেন। আর বিড়ালটি পরিতৃপ্ত হয়ে পানি পান করল। (জামে তিরমিযি, হাদিস নং-৯২)

২. হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে জাবের! তুমি কি বিয়ে করেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, কেমন মেয়ে বিয়ে করলে? কুমারী না অকুমারী? আমি বললাম : না, কুমারী নয়; বরং অকুমারী। তিনি বললেন, কোনো কুমারী মেয়েকে বিয়ে করলে না কেন? সে তোমার সাথে আমোদ-প্রমোদ করত। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ!

‘আমার বাবা উহুদের যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেছেন। তিনি নয়টি মেয়ে রেখে গেছেন। এখন আমার নয় বোন। এ কারণে আমি তাদের সাথে তাদেরই মতো একজন অনভিজ্ঞ মেয়েকে এনে একত্রিত করা পছন্দ করলাম না; বরং এমন একজন মহিলাকে (বিয়ে করা পছন্দ করলাম), যে তাদের চুল আঁচড়িয়ে দিতে পারবে এবং তাদের দেখাশোনা করতে পারবে। (এ কথা শুনে) নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি ঠিক করেছ।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৪০৫২)

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (র.) উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এতে স্ত্রীকর্তৃক স্বামী ও তার সন্তান, ভাইবোন এবং পরিবারের সেবা করার বৈধতার প্রমাণ রয়েছে। আর এ কথারও প্রমাণ রয়েছে, স্বামীর জন্য স্ত্রীর কাছ থেকে এরূপ খেদমত কামনা করতে অসুবিধা নেই, যদিও তা স্ত্রীর ওপর ওয়াজিব নয়। তবে হাদিস থেকে এ বিষয়টি জানা যায় যে, স্ত্রীদের এরূপ খেদমত করার প্রচলন সে যুগেও ছিল। এ কারণে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রী থেকে জাবের (রা.)-এর সেবা গ্রহণের উদ্দেশ্যের প্রতিবাদ করেননি।’ (ফাতহুল বারী ৯/১২৩) অতএব স্ত্রী স্বামীর মা-বাবাকে নিজের মা-বাবার মতো সম্মান ও সমীহের চোখে দেখবে, এটাই কাম্য। তাদেরকে মনেপ্রাণে ভালোবাসবে এবং তাদের সেবা করতে পারাকে নিজের জন্য সৌভাগ্য মনে করবে। এর বিনিময়ে সে পরকালে সওয়াব পাবে। অপরদিকে শ্বশুর-শাশুড়িরও করণীয় হলো, পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতো আদরযত্ন করা। তার সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশের প্রতি খেয়াল রাখা।
 
মূলত যৌথ পরিবারে সদস্যদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দ্বারাই শান্তি ও শৃঙ্খলা কায়েম হয়। শুধু একপক্ষের শ্রম ও মেহনত দ্বারা তা কখনো হতে পারে না। এজন্য সমাজের রীতি অনুযায়ী পরিবারে পুত্রবধূ যেমন শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্ন করে, তেমনি শ্বশুর-শাশুড়িও পুত্রবধূর অনেক কাজে তাকে সহযোগিতা করে থাকে। পুত্রবধূর কোনো সন্তান জন্ম নিলে দাদা-দাদি বৃদ্ধবয়সেও নাতি-নাতনিদের জন্য অনেক শ্রম ব্যয় করেন। আদর-যত্নে তাদের লালনপালন করেন। এটা কিন্তু তাদের আইনত দায়িত্ব নয়। তবুও তারা সানন্দে এ দায়িত্ব পালন করেন। আসলে বিষয়টি নৈতিকতা ও মানবতাবোধের সাথে জড়িত।

এ ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের দাবি হলো, স্ত্রীর ওপর শরিয়তকর্তৃক আরোপিত যতটুকু দায়িত্ব আছে, স্বামী তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে। এর অতিরিক্ত কোনো দায়িত্ব জোর করে তার ওপর চাপাবে না। তবে স্ত্রী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অতিরিক্ত কোনো কাজ আঞ্জাম দিলে সেটা ভিন্ন কথা। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর উক্ত কাজটি তার নৈতিকতাবোধের পরিচায়ক হবে। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কাছেই পরিষ্কার থাকতে হবে যে, পরিবারে কার দায়িত্ব কতটুকু এবং নৈতিকতার দাবি কী? স্ত্রী তার নৈতিকতার ভিত্তিতে শ্বশুর-শাশুড়ির যতটুকু সেবা করবে, তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে নিতে হবে এবং সে জন্য তাকে প্রশংসার দাবিদার মনে করতে হবে।

আমাদের সমাজে অনেক পুত্রবধূ নিজের সুখ নিশ্চিত করতে যেয়ে শ্বশুর-শাশুড়িকে জীবন্ত অভিশাপ ভেবে থাকে। এটি একটি জঘন্য চিন্তাধারা। পুত্রবধূ শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের পিতা-মাতার আসনে আসীন করলে তারাও তাকে আপন মেয়ের জায়গায় স্থান দিতে বাধ্য থাকবেন। কম বুদ্ধিমতি স্ত্রীরাই মাতৃতুল্য শাশুড়ি এবং পিতৃতুল্য শ্বশুরের সাথে সম্মান ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়। স্বামীর ছোট্ট ভাই-বোনকে নিজের ভাই-বোন বলে ভাবতে পারে না। তাদের সাথে সুন্দর ও ভালো আচরণ  করতে পারে না। অনেক উচ্চশিক্ষিত পুত্রবধূ শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা আইনের দৃষ্টিতে তার ওপর বর্তায় না বলে এড়িয়ে যেতে চায়। তারা ভুলে যায় যে, আইনের শুষ্ক-রুক্ষ পথে সুখের সংসার রচিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন ত্যাগ, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা ইত্যাদি মহৎ গুণাবলির চর্চা। তাই সুখের নীড় রচনা করতে পুত্রবধূর উচিত স্বতঃস্ফূর্তভাবে যতটুকু সম্ভব শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা। একে নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করা।

আর শ্বশুর-শাশুড়ি ও বাড়ির অন্য লোকদেরও ভুলে গেলে চলবে না যে, পুত্রবধূ বাড়ির সেবিকা বা চাকরানি নয়। তাকেই গামলাভর্তি কাপড় ধুতে হবে, রান্নাবান্না ও থালা-বাসন পরিষ্কার থেকে নিয়ে ঘরের সবকাজ তাকেই করতে হবে; এমনটি নয়। সেও একজন মানুষ, তাঁরও আছে স্বাদ-আহ্লাদ। প্রয়োজন আছে বিশ্রামের। অনেক পরিবারে বউ আসার পর কাজের লোক রাখার প্রয়োজন অনুভব করা হয় না। আসলে একটি সুখী পরিবার গঠনে বউ ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য- উভয়দিক থেকেই ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ জরুরি।

আর স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে একজনের দ্বারা আরেকজনের হক নষ্ট না হয় এবং কারো প্রতি জুলুম না হয়। মাতৃভক্তিতে ত্বারিত হয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা কিংবা স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মা-বাবার দিলে আঘাত দেওয়া কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আচরণ এমন হওয়া উচিত, যেন দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন আরেকজনকে উত্তম স্বামী ও উত্তম স্ত্রী মনে করবে। দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্য শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা ও সচেতনতা অতি প্রয়োজন। এ বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। আল্লাহতায়ালা আমাদের অন্তরে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের মানসিকতা এবং আখেরাতে জবাবদিহিতার ভয় সৃষ্টি করে দিন। দুনিয়ার জীবনকে সুখময় করে দিন। আমিন!

লেখক : পরিচালক, জামেয়া শায়েখ আরশাদ মাদানী, ময়মনসিংহ

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!