ঢাকা : প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে রোজা বা উপবাস থাকার প্রচলনটা চলে আসছে। সবশেষে ইসলাম ধর্মে এর একটি পরিপূরক নিয়ম উঠে এসেছে। যা আল কোরআনে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরাব্বুল আলামীন উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৩) উল্লিখিত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, কেবল উম্মতে মুহাম্মদীর সাথেই রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমরা (রমজানের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা রাখবে আর যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা বন্ধ করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে ত্রিশ দিন রোজা রাখবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৯০৯)
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও গবেষণার যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেছেন, যদি সুস্থ থাকতে চাও, তাহলে উপবাস থাকো। মানবদেহ আল্লাহরাব্বুল আলামীনের এমন এক বিস্ময়কর সৃষ্টি যাকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই। দেহের কোষ, জীবাণু, হাজারো রকম রোগের প্রবেশ, রোগকে বিনাশ, ডিএনএসহ নানা বিষয়ের গবেষণা কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। এখন জানার বিষয় হলো, রোজার সময় দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থাকা আমাদের শরীরকে কিভাবে প্রভাবিত করছে। রোজা আমাদের শরীরের জন্য কি আদৌ উপকারী? নাকি রোজা আমাদের শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক মুসলিম এবং অমুসলিম বিজ্ঞানী এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়েছেন এবং চালাচ্ছেন।
রোজা পালন করতে গিয়ে একজন মুসলিমের রমজান মাসের প্রতিদিন সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব প্রকার পানাহার ও শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকতে হয়। এছাড়াও মুসলিমরা এই সময় সব প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থেকে নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এ কারণে রোজা যে শুধু মাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতিই সাধন করে তা নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক উন্নতিও ঘটায়। রোজার কিছু বিশেষ উপকারিতা নিচে আলোচনা করা হলো।
ওজন হ্রাসে সহায়ক : পূর্বেই উল্লিখিত, দীর্ঘসময় ধরে রোজা অর্থাৎ পানাহার থেকে বিরত থাকার ফলে আমাদের দেহ তার প্রয়োজনীয় শক্তি আহরণের জন্য দেহের বিভিন্ন ফ্যাটি টিস্যু এবং মাংসপেশী ও লিভারে জমে থাকা অতিরিক্ত গ্লুকোজ বার্ন করে দেয়। এর ফলে দেহের ওজন হ্রাস পায় এবং শারীরিক গঠন স্বাভাবিক ও সুঠাম থাকে।
অতিরিক্ত ক্ষুধা নিবারণ : রোজার পুরো সময়টিতে পানাহার থেকে বিরত থাকা এবং সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেহ ঘন ঘন ক্ষুধার্ত বোধ না করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে রোজা শেষ করে ইফতার গ্রহণের সময় আমরা বেশি খাদ্যগ্রহণে অনীহাবোধ করি এবং পাকস্থলী সংকুচিত থাকার ফলে আমরা প্রয়োজনের চেয়ে কম খাবার খেয়ে সন্তুষ্ট থাকি। পরিমিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে কম খেয়েও আমাদের দেহ পরিপূর্ণ থাকে, থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন স্বাভাবিক থাকে এবং মেটাবোলিজম বুস্ট হয়।
পুষ্টি শোষণে কার্যকর : দীর্ঘসময় ধরে রোজা রাখায় এবং গভীর রাতে সাহরি করার ফলে আমাদের দেহে অ্যাডিপোনেক্টিন (ধফরঢ়ড়হবপঃরহ) নামক একটি হরমোন তৈরি হয়। এর ফলে আমাদের বিপাকক্রিয়ার কার্যকারিতা আরো সচল হয় এবং আমাদের দেহ এবং মাংসপেশী খাদ্য থেকে বেশি পুষ্টি শোষণে সক্ষম হয়। তবে গর্ভবতী এবং সদ্য মা হওয়া নারীদের জন্য রোজার পুরো সময়টিতে দেহে পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং শক্তি গ্রহণের বিষয়টি বেশ জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ।
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে : আমাদের দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মূলত শ্বেত রক্তকণিকা দ্বারা পরিচালিত। রোজা রাখার ফলে পুরনো শ্বেত রক্তকণিকাগুলো পুনরায় পুনরোজ্জীবিত হয় এবং আগের চেয়েও স্বাস্থ্যকর ও দৃঢ় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এছাড়াও, রোজার পরে ইফতারে পুনরায় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেহের স্টেম সেলগুলো আবারো সজীব হয়ে ওঠে। ফলে দেহ সতেজ ও সুস্থ থাকে।
রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে : রোজায় সাধারণ খাদ্যাভ্যাস পরিহারের মাধ্যমে খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের মাত্রাও কমে যায়। এছাড়াও রেচন প্রক্রিয়ায় দেহের অতিরিক্ত লবণ বের হয়ে যায় বলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : শারীরিক সুস্থতায় রোজার অন্যতম বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা পাওয়া যায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে। স্বল্প পানাহারের কারণে রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়। এর ফলে টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।
ক্যানসার ঝুঁকি কমায় : ক্যানসারের ক্ষেত্রে উপবাসের কোনো প্রভাব আছে কি না তা নিয়ে মানুষের ওপর এখনো কোনো গবেষণা না হলেও প্রাণিদের ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে ইতোমধ্যে এবং তাতে দেখা গেছে-উপবাসের ফলে তাদের লিম্ফোমার ঝুঁকি কমেছে। টিউমার অপসারণ পরবর্তী বেঁচে থাকার হার বেড়েছে এবং ক্যানসারাস কিছু কিছু সেলের ফের বৃদ্ধিকে ঠেকায়। হ্যাঁ, রোজার আত্মকেন্দ্রিক শিক্ষা অল্প খাদ্যের প্রতি আহ্বান জানায়। কারণ, অল্প খাদ্য মানুষকে ইবাদতের জন্য প্রস্তুত করে। রমজানে তারাবির নামাজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য একটি উচ্চ ব্যায়ামের মতো। এতে করে যে পরিমাণ ক্যালোরি ব্যয় হয় রোজা রাখার দ্বারা তার থেকেও বেশি ক্যালোরি শরীরে তৈরি হয়।
লেখক: তারেক সাঈদ, আলেম, প্রাবন্ধিক।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :