• ঢাকা
  • রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১

জুমার দিনে সুরা কাহফ তেলাওয়াত


মুহাম্মদ মিযানুর রহমান জুন ৪, ২০২১, ১২:৩৫ পিএম
জুমার দিনে সুরা কাহফ তেলাওয়াত

ঢাকা : জুমার দিন মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক ঈদ। ইবাদতের বসন্ত। মহিমান্বিত বরকত ও ফজিলতপূর্ণ একটি দিন। বাবা-ছেলে, যুবক- বৃদ্ধা, শিশু-তরুণ সবাই উপস্থিত হয় পাড়ার মসজিদে। সে এক অভূতপূর্ব বরকতের দৃশ্যের অবতারণা। ফেরেশতাদের পাক জবান দোয়া করে মসজিদে ছুটে আসা মুসল্লিদের জন্য।

আর এই জুমার দিনের বিশেষ কিছু আমল করে দিনকে বানানো যায় আরো বরকতময়। জুমার দিনে রয়েছে ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল। এগুলো মধ্যে একটি আমল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে জুমার দিনে ‘সুরা কাহফ’ তেলাওয়াত করা। পবিত্র কোরআনুল কারীমের ১৫তম পারার ১৮নং সুরা এটি। যদি কেউ সম্পূর্ণ সুরাটি তেলাওয়াত করতে না পারে তবে সে যেন এ সুরার প্রথম এবং শেষ ১০ আয়াত অথবা যে কোনো দশ আয়াত তেলাওয়াত করে।

জুমার দিনে ‘সূরা কাহাফ’ তেলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরিফে রয়েছে বিস্তারিত আলোচনা। হজরত বারা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাতে সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করছিলেন। তার কাছে দুটি রশি দিয়ে একটি ঘোড়া বাঁধা ছিল। এরই মধ্যে একটি মেঘখণ্ড এসে তাকে ঢেকে ফেলল। এরপর যখন মেঘখণ্ডটি তার কাছে চলে আসছিল, তখন তার ঘোড়া ছোটাছুটি করতে লাগল। অতঃপর সকালে ওই ব্যক্তি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে রাতের ঘটনা বললেন। তিনি বললেন, ওটা ছিল সাকিনা (রহমত), যা কোরআন তেলাওয়াতের বরকতে নাজিল হয়েছিল। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫০১১) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা আল-কাহাফ পড়বে, তার (ঈমানের) নূর এ জুমা হতে আগামী জুমা পর্যন্ত চমকাতে থাকবে।’ (মিশকাত, হাদিস নং-২১৭৫)

দাজ্জালের ফেতনা বড় ভয়ংকর ফেতনা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দাজ্জাল ফেতনার আলোচনা করতেন-তখন তিনি দাজ্জালের ফেতনা থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ দোয়া করতেন। সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করলেও আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের ফেতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি সুরা আল-কাহাফের প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ করবে তাকে দাজ্জালের অনিষ্ট হতে নিরাপদ রাখা হবে।’ (সহিহ মুসলিম) অন্যত্র বলেন, ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহাফ পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন তার জন্য এমন একটি নূর হবে, যা তার অবস্থানের জায়গা থেকে মক্কা পর্যন্ত আলোকিত করে দেবে। আর যে ব্যক্তি উহার শেষ দশটি আয়াত পাঠ করবে, তার জীবদ্দশায় দাজ্জাল বের হলেও সে তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সিলসিলায়ে সহিহা, হাদিস নং-২৬৫১) জুমার দিনে সুরা কাহাফ পাঠ করলে কিয়ামত দিবসে তার পায়ের নিচ থেকে আকাশের মেঘমালা পর্যন্ত নূর আলোকিত হবে এবং দুই জুমার মধ্যবর্তী গুনাহ মাফ হবে।’ (আত তারগীব ওয়াল তারহীব-১/২৯৮)

হজরত ইবনে মারদাওয়াইহ্  রহমাতুল্লাহ আলাইহি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘যেই ঘরে এই সুরা কোনো রাতে তেলাওয়াত করা হয়, সেই ঘরে ওই রাতে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না।’ হজরত কাতাদা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, সুরা কাহাফ মক্কায় নাজিল হয়েছে। আর এ সুরা সম্পর্কে নবী কারীম সল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আমি কি সেই সুরা সম্পর্কে তোমাদেরকে বলবো না; যা নাজিল হওয়ার সময় সত্তর হাজার ফেরেশতা অবতরণ করেছিল? তা হলো সুরা কাহাফ।’ আরো বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি সুরা কাহাফ লিখে একটি বোতলে সংরক্ষণ করে নিজ ঘরে রাখবে, সে কারো মুখাপেক্ষী হবে না এবং ঋণগ্রস্তও হবে না । আর তার পরিবারবর্গকে কেউ কষ্ট দিতে পারবে না।’ (তাফসিরে জালালাইন : খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৮)

সুরা কাহাফের তেলাওয়াত মাধ্যমে অর্জিত হয় ব্যাপক শিক্ষা। সুরা নাজিল  হ‌ওয়ার শানে নুজুলটাও বেশ দারুণ। এই সুরার বিষয়বস্তু হলো আসহাবে কাহাফ, মুসা (আ.), খিজির (আ.) ও যুলকারনাইন (আ.) সম্পর্কে। কাফেরদের করা প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও রিসালাতকে অস্বীকার করা। তাই এ সুরার শুরুতে পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, পবিত্র কোরআন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও রিসালাতের সর্বশ্রেষ্ঠ দলিল। এরপর আসহাবে কাহাফের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আসহাবে কাহাফের ঘটনা দ্বারা মানবজাতির পুনরুত্থানের কথা প্রমাণ করা উদ্দেশ্য ছিল। তাই আসহাবে কাহাফের বর্ণনার পর দুনিয়ার অস্তিত্ব এবং আখেরাতের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।

হজরত ইবনে জারির ইকরিমা সূত্রে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, কুরাইশ গোত্রের লোকেরা নজর ইবনে হারেস ও ওকবা ইবনে আবু মুঈত নামক দুই ব্যক্তিকে এই নির্দেশ দিয়ে মদিনায় পাঠায় যে, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থা মদিনার ইহুদি ধর্মযাজকদের কাছে বর্ণনা করো এবং তাদের কাছে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো। কারণ তাদের কাছে জ্ঞানের যে ভাণ্ডার রয়েছে আমাদের কাছে তা নেই। আর তারা তাঁর ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেয় তা আমাদেরকে জানাও। এরপর উভয় দূত যথাসময়ে মদিনায় পৌঁছে ইহুদি ধর্মযাজকদের সাথে সাক্ষাৎ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থা তাদের কাছে বর্ণনা করে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তখন ইহুদি ধর্মযাজকরা বললো, তোমরা তাঁকে তিনটি প্রশ্ন করো । যদি তিনি এ তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেন তাহলে নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, তিনি অবশ্যই আল্লাহর প্রেরিত রাসুল । আর যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি দিতে না পারেন, তাহলে জেনে রাখো, তিনি সত্য নবী নন। প্রশ্ন তিনটি হলো- ১. সেই যুবকগণ কারা ছিলেন, যারা পূর্বে বিদায় নিয়েছেন এবং যাদের ঘটনা সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত বিস্ময়কর? আর সেই ঘটনাগুলো কী? ২. সে ব্যক্তি কে? যিনি সারা পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং তাঁর ঘটনাবলি কী? ৩. রূহের তাৎপর্য কী?

কুরাইশদের প্রেরিত দুই ব্যক্তি মক্কায় ফিরে এসে কুরাইশদেরকে তাদের ভ্রমণের ফলাফল জানিয়ে দেয়। এরপর তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই তিনটি প্রশ্ন করে। উত্তরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ‘আমি আগামীকাল বলবো।’ কিন্তু তিনি ইনশাআল্লাহ বললেন না। তাই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে পনেরো দিন বিলম্ব হয়। এর মাঝে হজরত জিবরাঈল (আ.)ও আসেননি এবং আল্লাহতায়ালা কোনো ওহীও প্রেরণ করেননি। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েন। আর এদিকে দুর্বৃত্ত কাফেররা ভিত্তিহীন-বানোয়াট কথাবার্তা ছড়াতে শুরু করে। অবশেষে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হজরত জিবরাঈল (আ.) সুরা কাহাফ নিয়ে অবতরণ করেন। এই সুরায় প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। রূহ সম্পর্কীয় প্রশ্নের উত্তর সুরা বনী ইসরাঈলে আলোচনা করা হয়েছে। (তাফসিরে মাযহারী: খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-১৬৮)

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি জুমার দিন এ সুরা তিলাওয়াত করতেন। এর রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন উপকারিতা। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, তাকে দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়টাতে নূর দান করা হবে।’ (সহিহ আল-জামে, হাদিস নং-৬৪৭০) আর সুরা কাহাফের তেলাওয়াত সময় হলো, বৃহস্পতিবার দিন শেষে সূর্য ডোবার পর থেকে শুক্রবার সূর্য ডোবা পর্যন্ত। সুতরাং উক্ত সময়ের যে কোনো সময় সুরা কাহাফ পাঠ করলে হাদিস অনুযায়ী আমল করা হবে। উল্লেখ্য, তা এক বৈঠকে পুরা সুরা পড়া জরুরি নয়; বরং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে শুক্রবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত একাধিক বৈঠকে ভাগ ভাগ করে উক্ত সুরা পড়ে শেষ করলেও একই সওয়াব পাওয়া যাবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে পবিত্র জুমার দিনে সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করে এর ফজিলত হাসিল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক
[email protected]

Wordbridge School
Link copied!