ঢাকা : ইসলামের কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদত পালন করলেই মুসলিম হওয়া যায় না। মুসলিম হতে গেলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি কথার প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী পৃথিবীতে চলতে হবে। যারা মুখে বলে যে, তারা আল্লাহর বিধানকে বিশ্বাস করে কিন্তু তাদের অন্তর একথার ওপর স্থির নয়; ইসলামের পরিভাষায় তাদেরকে বলে মুনাফিক।
মুনাফিকরা মুসলিম সমাজের বাইরের কেউ নয় এরা মুসলমানদের সাথে বসবাস করে। তাদের সাথেই নামাজ আদায় করে। তাদের সাথেই হাট-বাজারে ঘোরাফেরা করে। ধানের মাঝে যেমন চিটা থাকে তেমনি মুসলমানদের মাঝেই এই মুনাফিকদের বসবাস। এরা মুসলমানদের জন্য এবং ইসলামের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই মহান আল্লাহতায়ালা এদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা পবিত্র কোরআনে বলে দিয়েছেন যাতে করে মুমিন ব্যক্তিরা সহজেই এদেরকে চিহ্নিত করতে পারে এবং এদের থেকে সতর্ক থাকতে পারে। পবিত্র কোরআনের শুরুর দিকেই আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘মানুষদের মাঝে কিছু (লোক এমনও) আছে যারা (মুখে) বলে আমরা আল্লাহতায়ালা ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি (আসলে) এরা মোটেই ঈমানদার নয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-৮)
এই লোকগুলো সমাজে মুসলিমদের সামনে ঈমানের দাবি করে। তারা শুধু মুখে ইসলামের কালেমা পড়ে। মুখের ভাষায় তারা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং বলে আল্লাহতায়ালা ও পরকালের প্রতি তারা বিশ্বাসী। কিন্তু তাদের অন্তরে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল নয়। তাই আল্লাহতায়ালা বলেছেন এরা ঈমানদার নয়। তবে তারা কেন এই কথা বলে?
এ প্রশ্নের জবাবে মহান আল্লাহরাব্বুল আলামিন বলেন- ‘এরা আল্লাহতায়ালা ও তার ঈমানদার বান্দাদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তারা অন্য কাউকে নয়, নিজেদেরই ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। যদিও (এ ব্যাপারে) তারা কোনো প্রকারের চৈতন্য রাখে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-৯)
মুনাফিকরা আল্লাহ ও ঈমানদারদের সাথে ধোঁকাবাজি করে। ঈমানের কথা বলে তারা নানাবিধ সুযোগ সুবিধা হাসিল করতে চায়। তারা যেন শক্তিশালী মুসলিম বাহিনীর রোষানলে না পড়ে এবং সামাজিক নিরাপত্তা লাভ করে, এরকম পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্যই তারা ঈমানদারদের সাথো ধোঁকাবাজি করে চলাফেরা করে কিন্তু তাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে তারা বুঝতে পারে না যে, তারা নিজেরাই নিজেদের ধোঁকা দিচ্ছে। কারণ যে ব্যক্তি কোনো সৎকাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই করে আবার যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় কাজ করে তার শাস্তিও তাকেই ভোগ করতে হবে। এর দ্বারা আল্লাহর কোনো লাভ বা ক্ষতি হবে না। কারণ মহান আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি জগতের মুখাপেক্ষী নন।
মুনাফিকরা ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য দরবেশের মতো পোশাক পরিধান করে। তাদের বেশ ভুষা দেখলে মনে হবে এ ব্যক্তি নিশ্চয় আল্লাহর প্রিয় বান্দা। ইসলামী পোশাক বলতে যা বুঝায় তা তারা যথাযথভাবেই পরিধান করে। তাদের টুপি দাড়ি আর আলখেল্লা দেখে বুঝার উপায় থাকে না যে, তারা মুনাফিক। তারা কথার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত মিষ্টি মধুর কথা বলে। কথা শুনলে মনে হবে এই মানুষের দ্বারা কোনো পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া অসম্ভব। মুনাফিকরা
এরকম চাকচিক্যতা প্রদর্শন করবে সে কথা আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করে বলেন- ‘তুমি যখন তাদের দিকে তাকাবে তখন তাদের (বাইরের) দেহাবয়ব তোমাকে খুশি করে দেবে আবার যখন তারা তোমার সাথে কথা বলবে তখন তুমি (আগ্রহভরে) তাদের কথা শুনবেও।’ (সুরা মুনাফেকুন, আয়াত-৪)
তাদের বাইরের এই রূপ দেখে যেন ঈমানদার ব্যক্তিরা প্রতারিত না হয় সে জন্য আল্লাহতায়ালা তাদের বৈশিষ্ট্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। কারণ আল্লাহতায়ালা তাঁর ঈমানদার বান্দাদের ভালোবাসেন। এই মুনাফিকরা যেহেতু মুমিনদের সাথে বসবাস করে। তাই তারা ইসলামের অনেক হুকুম ঈমানদারদের সাথেই পালন করে। ইবাদত পালনের পদ্ধতির মাধ্যমেও মুনাফিকদের চিহ্নিত করা যায়। মুসলিমদের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত হলো নামাজ। মুমিন ব্যক্তি যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন সে তার সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়ায়, তার মন থাকে বিনীত এবং ভয়ার্ত। পক্ষান্তরে কোনো মুনাফিক যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন সে মুমিন ব্যক্তির মতো দাঁড়ায় না। তার নামাজে দাঁড়ানোর বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন- ‘অবশ্যই মুনাফিকরা আল্লাহতায়ালাকে ধোঁকা দেয়, (মূলত এর মাধ্যমে) তিনিই (আল্লাহই) তাদের প্রতারণায় ফেলে দিচ্ছেন, এরা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন একান্ত আলস্য ভরেই দাঁড়ায় তারা কেবল লোকদের দেখায়। এরা আল্লাহতায়ালাকে কমই স্মরণ করে।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৪২)
তাদের এই অলসতার কারণে নামাজ পরিপূর্ণ হয় না। আর এর দ্বারা তারা উপকৃতও হতে পারে না। মুমিনরা পবিত্র ঘর মসজিদে জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করে নিজেদের ভেতরের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। আর মুনাফিকরা মসজিদে গিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। মুমিনদের একতাকে তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়।
মুনাফিকের দল নিজেরা সবসময় পাপ কাজ, অন্যায় কাজের মাঝে ডুবে থাকে। অপরের সম্পদ জোর করে ভোগ দখল করে। তারা দুর্বল মানুষের ওপর প্রতিপত্তির জোরে অবিচার করে। তাদের কাছে কেউ যখন কোনো পরামর্শের জন্য আসে তখন তারা তাদেরকে সুপরামর্শের বদলে কুপরামর্শ দেয়। তাদের কাছে যখন কোন অভাবী, গরিব, মিসকিন সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় তখন তারা দান খয়রাত করে না। তারা এতিমের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না।
মহান আল্লাহতায়ালা মুনাফিকদের এরকম কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ্য করে বলেন, ‘মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এরা একে অপরের মতোই তারা অসৎকাজের আদেশ দেয় ও সৎকাজ থেকে বিরত রাখে এবং (আল্লাহতায়ালার পথে খরচ করা থেকে) উভয়েই নিজেদের হাত বন্ধ করে রাখে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-৬৭)
মুনাফিকরা মুসলিম সমাজের আগাছা। যারা মুমিনদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করার জন্য সর্বদা ওঁৎ পেতে থাকে। মহান আল্লাহতায়ালা এই সমস্ত মুনাফিকদের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করেছেন এবং তিনি তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা মুনাফিকদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করে।
মহান আল্লাহ বলেন- ‘তুমি এদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো কিংবা না করো (এ দু-টোই) তাদের জন্য সমান। (কারণ) আল্লাহতায়ালা কখনোই তাদের ক্ষমা করবেন না; আল্লাহতায়ালা কোনো নাফরমান জাতিকে হেদায়েত দান করেন না। (সুরা মুনাফেকুন, আয়াত-৬)
আল্লাহরাব্বুল আলামিন মুনাফিকদেরকে ক্ষমা না করার ঘোষণা দিয়েছেন। পরকালে তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তারা যেমনিভাবে এই পৃথিবীতে আল্লাহকে ভুলে গিয়ে, তার নাজিলকৃত বিধানকে ভুলে গিয়ে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে জীবনকে পরিচালিত করেছে তেমনিভাবে বিচারের দিনেও মহান আল্লাহ এই সমস্ত মুনাফিকদের ভুলে যাবেন এবং তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেবেন।
মুনাফিকদের শাস্তির ঘোষণা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহতায়ালা মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং কাফেরদের জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যেখানে তারা চিরকাল থাকবে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-৬৮)
জাহান্নাম এমন একটি ভয়াবহ জায়গা যা বর্ণনা করে কোনো মানুষকে বুঝানো সম্ভব নয়। জাহান্নামীদের খাবার দেওয়া হবে গলিত রক্ত, পুঁজ এবং কাঁটাযুক্ত ফল এবং তাদেরকে পান করতে দেওয়া হবে ফুটন্ত গরম পানি; যা তাদের নাড়ি ভুঁড়িকে ছিঁড়ে দিবে। আল্লাহতায়ালা মুনাফিকদেরকে এমন ভয়াবহ আজাবের স্থান জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন এবং তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। সেখানে তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তারা মৃত্যু কামনা করবে কিন্তু তাদেরকে মত্যু দেওয়া হবে না। আল্লাহতায়ালা মানুষের অপরাধ অনুপাতে তাদেরকে জাহান্নামের বিভিন্ন স্তরে রাখবেন।
এক্ষেত্রে মুনাফিকদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘এ মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে, তুমি সেদিন তাদের জন্যে কোনো সাহায্যকারী খুঁজে পাবেনা।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৪৫)
মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অনন্তকাল ধরে জ্বলতে থাকবে। তারা এই ক্ষণকালীন পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা ও ঈমানদারদের সাথে প্রতারণা করে পরকালীন স্থায়ী জাহান্নামকে ক্রয় করে নিয়েছে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক
[email protected]