ঢাকা: রমজান মাসের শেষ দশক চলছে। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে এবারের রমজানের ২১ দিন। তবে রমজানের শেষের ১০ দিনের বেজোড় রাতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। শেষ দশকের যেকোনো এক বিজোড় রাত শবে কদরের।
এ রাতেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। মুমিনরা হাজার মাসের থেকে উত্তম শবেকদর অনুসন্ধান করে থাকেন। এই রাতে আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হয়।
এটি মহিমান্বিত এক রাত। যে রাতকে আল্লাহ তাআলা বলেছেন ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’ (সুরা কদর: ৩)। অতএব এই রাতের যেকোনো আমলের সওয়াব টানা হাজার মাস করার মতোই। তাই লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বেখবর হওয়া এবং এ থেকে বঞ্চিত হওয়া মুসলমানের জন্য খুবই দুঃখজনক। রাসুলুল্লাহ (স.) পবিত্র রমজানে বিশেষ করে শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করতেন। এজন্য তিনি ইতেকাফ করতেন।
নবীজির শবে কদর অনুসন্ধান
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) রমজানের প্রথম ১০ দিন ইতেকাফ করেছেন। অতঃপর মধ্যবর্তী ১০ দিন ইতেকাফ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি লাইলাতুল কদরের তালাশে ইতেকাফ করেছি। আমাকে বলা হলো, লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকে। অতএব, কেউ ইতেকাফ করতে চাইলে সে ইতেকাফ (শেষ দশকে) করতে পারে। ফলে লোকজন তার সঙ্গে ইতেকাফ করল। (মুসনাদে আহমদ: ১১৭০৪)
বিজোড় রাতে শবে কদর অনুসন্ধান
লাইলাতুল কদর তালাশ করা মানে এই রাতের বিশেষ ফজিলত লাভের আশায় ইবাদতে আত্মমগ্ন থাকা। আমাদেরও উচিত রমজানের শেষ দশকটি বিশেষ করে বিজোড় রাতগুলো ইবাদতে কাটানো এবং গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা। আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের সন্ধান কর।’ (সহিহ বুখারি: ২০১৭, সহিহ মুসলিম: ১১৬৯)
শবে কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম
মহাগ্রন্থ কোরআনুল কারিম নাজিল হয়েছে লাইলাতুল কদরে। এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি একে নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে (লাইলাতুল কদর)। আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কী? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতারা এবং রুহ তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাতে শান্তিই শান্তি, ফজর হওয়া পর্যন্ত।’ (সুরা কদর: ১-৫)
শবে কদরের ইবাদতে অতীতের গুনাহ মাফ হয়ে যায়
প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত জাগবে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (সহিহ বুখারি: ৩৫)
যে আমলটি করলে শবে কদর পাওয়া যাবে
শবে কদর পাওয়ার জন্য একটি আমলের বিকল্প নেই। সেটি হলো- মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করা। তাহলে হাদিস অনুযায়ী শবে কদরের ফজিলত লাভ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কেননা হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সঙ্গে পড়ে, সে যেন সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে।’(মুসলিম: ৬৫৬)
তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে- রমজানের শেষ দশকে জামাতে নামাজ মিস না করা। অন্তত এশা ও ফজর অবশ্যই জামাতে পড়া। তাহলে হাদিস অনুযায়ী, সারারাত নামাজের সওয়াব পাওয়া যাবে। আর সারারাত ইবাদত মানে শবে কদর পাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তবে, যারা ইতেকাফ করছেন তারা নিশ্চিতভাবেই শবে কদর লাভ করবেন। ইতেকাফ অবস্থায় কেউ যদি রাতে ঘুমিয়েও থাকে, তবু তাকে ইবাদতকারীদের মধ্যে শামিল করা হবে। তখন শবেকদরের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতে ব্যয় করার ফজিলত অর্জন করবেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, في المعتكف هو يعكف الذنوب و يجري له من الحسنات كعامل الحسنات كلها ‘সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, বাবুস সাওম)
‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’ কথাটির ব্যাখ্যা
হাজার মাসের চেয়ে উত্তম অর্থ শুধু যে একহাজার মাসের চেয়ে উত্তম-বিষয়টি এমন নয়, বরং অনেক বেশি বোঝাতেও হাজার শব্দটা ব্যবহার করা হয়। তারপরও আমরা যদি এখানে শুধু এক হাজার মাসই ধরি এর সময় দাঁড়ায় ৮৩ বছর ৪ মাস। তার মানে ৮৩ বছর ৪ মাস পর্যন্ত ইবাদত করার যে ফজিলত বা সওয়াব পাওয়া যায় তা এ এক রাতের ইবাদতের দ্বারাই মহান আল্লাহ প্রদান করে থাকেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘এ মাসে (রমজানে) এমন একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সত্যিই বঞ্চিত হলো।’ (সুনানে নাসায়ি: ২১০৮)
শবে কদর কবে-এর সরাসরি উত্তর কোরআন-হাদিসে আসেনি। তাই নবীজি রমজানের শেষ দশকে শবে কদর তালাশ করতে বলেছেন। (বুখারি: ২০১৭) উবাদা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (স.) ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে খবর দিতে বের হলেন। এ সময় দুই মুসলমান ঝগড়া করছিলেন। তখন নবী (স.) বললেন, ‘আমি আপনাদের ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে অবহিত করতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হওয়ায় তা (সেই জ্ঞান) উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আশা করি, উঠিয়ে নেওয়াটা আপনাদের জন্য বেশি ভালো হয়েছে। আপনারা সপ্তম (২৭তম), নবম (২৯তম) এবং পঞ্চম (২৫ তম) তারিখে এর সন্ধান করুন।’ (সহিহ বুখারি: ৪৯)
মূলত শবে কদরের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ অজানা রাখার পেছনে আল্লাহ তাআলার বিশেষ হেকমত নিহিত। এতে উম্মতের কল্যাণ রয়েছে বলেই নবীজিকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাফসিরের কিতাবগুলোতেও এটাই সারসংক্ষেপ। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘আলেমগণ বলেন, এই রাতটির নির্দিষ্ট তারিখ গোপন রাখার পিছনে হেকমত হলো- মানুষ যেন এ রাতের মর্যাদা লাভের জন্য চেষ্টা সাধনা করে। নির্দিষ্ট তারিখ জানা থাকলে- মানুষ শুধু নির্দিষ্টভাবে সেই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করত। (ফাতহুল বারি: ৪/২৬৬)
তবে, শবে কদরের সম্ভাব্য হিসাবে রমজানের ২৭তম রাতকে অগ্রগণ্য ধরা হয়। হাদিসের গবেষকরা বলেন, রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলিলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন হাদিস থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (ফাতাওয়াউল লাজনাহ আদ্-দায়িমা; সৌদি আরবের ফতোয়াবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র: ১০/৪১৩)
এআর