Menu
ঢাকা : রমজান মাসের প্রধান কর্তব্য রোজা আদায় করা। তবে এ মাসের সঙ্গে দুটি আর্থিক ইবাদতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটি হলো জাকাত, অন্যটি সদাকাতুল ফিতর।
ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদি ইবাদত জাকাত আদায়ের জন্য কোনো মাস নির্ধারিত নেই। কিন্তু আল্লাহর নেককার বান্দারা জাকাত আদায়ের জন্য এই মাসটি বেছে নেন বেশি ছওয়াব লাভের আশায়। কেননা মহানবী (সা.) এ মাসের যেকোনো ইবাদতের প্রতিদান অন্য মাসগুলোর তুলনায় অনেক বেশি বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল ইবাদত করলে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান পাবে। আর কেউ এ মাসে একটি ফরজ আদায় করলে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান পাবে। এ জন্য রমজান মাস জাকাত আদায়ের একটা ভালো সময় বলে মনে করা হয়।
জাকাত ইসলামের প্রধান আর্থিক ইবাদত। কারো কাছে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সমান মূল্যের বর্ধনশীল সম্পদ এক বছর সঞ্চিত থাকলে তা থেকে ৪০ ভাগের ১ ভাগ জাকাত আদায় করতে হয়। যখন এ সম্পদ সঞ্চিত হবে, তখন থেকে চাঁদের হিসেবে এক বছর পূর্ণ হলে জাকাত ফরজ হয়। ইসলামের এই হুকুমটি মহানবী (সা.)-এর হিজরতের আগেই নাজিল হয়েছিল। তবে তখন এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু করা হয়নি। তা ছাড়া সম্পদের শ্রেণিবিন্যাসও করা হয়নি। মহানবীর হিজরতের পর এ সম্পর্কে বিস্তারিত আহকাম নাজিল হয়।
সম্পদ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এই যে, সব কিছুর মালিক আল্লাহ তাআলা। মানুষের কাছে তা আমানত। আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেকই সম্পদ ব্যয়ের অনুমতি রয়েছে। কেউ নিজের শ্রম ও মেধা ব্যয় করে যে সম্পদ উপার্জন করে, তা ভোগ করার নিরঙ্কুশ অধিকার তার নেই। বরং অভাবী ও বঞ্চিত মানুষেরও তাতে প্রাপ্য রয়েছে। তাদের সেই প্রাপ্য পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সেই প্রাপ্য অংশ কত সে সম্পর্কে প্রথম দিকে বেশ কঠিন আদেশ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা-ই থাকবে, তা সদকা করতে হবে (সুরা-বাকারা, আয়াত-২১৯)। সম্পদ সঞ্চয় করে রাখার কঠোর নিন্দা করা হয় এবং এ জন্য কেয়ামতের দিন কঠিন আজাব ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ার করা হয় (সুরা : তওবা, আয়াত-৩৪)।
এটা ছিল আতঙ্কের বিষয়। হজরত ওমর (রা.) এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারপর জানিয়ে দেওয়া হয়, সঞ্চিত সম্পদের জাকাত আদায় করলে তা আর নিন্দনীয় থাকবে না।
জাকাত সংগ্রহে নিযুক্ত কর্মী, নও মুসলিম, ঋণী, মুক্তিপ্রত্যাশী দাস-দাসি, মুজাহিদ ও মুসাফির (সুরা-তওবা, আয়াত-৬০)।
শেষের পাঁচ শ্রেণি দারিদ্র্যের শর্তে জাকাত পাওয়ার উপযোগী হয়। নও মুসলিম শ্রেণি সব সময়ই ছিল। তারা মুসলিম সমাজের সহানুভূতি ও সহযোগিতা লাভের হকদার। যারা সবেমাত্র মুসলমান হয়েছে, এখনো দৃঢ়তা আসেনি তাদের অসহায়তা দূর করার জন্য যেমন আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, তেমনি যাদের ঈমান দৃঢ় হয়েছে তাদেরও প্রয়োজন অন্যদের উৎসাহিত করা। কোনো দাস বা দাসি যদি মুক্তি লাভের জন্য মনিবের সঙ্গে আর্থিক চুক্তি করে, তাহলে তাকে সেই অর্থ পরিশোধে সহায়তার জন্য জাকাতের অর্থ দান করা যায়। বর্তমানে দাসপ্রথা নেই। কিন্তু যারা বিনা বিচারে কারাগারে বন্দি থাকে, তারা এ শ্রেণির আওতায় পড়বে। আইনি সহায়তা করে তাদের মুক্ত করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এ জন্য প্রয়োজনে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। মুসাফির ব্যক্তি নিজ বাড়ি থেকে দূরে থাকার কারণে সাময়িকভাবে আর্থিক কষ্টে পড়লেও তাকে জাকাতের অর্থ দিয়ে সহায়তা করা যাবে।
সিয়ামের অনুষঙ্গ সদাকাতুল ফিতর। মাহে রমজান উম্মতে মোহাম্মদির জন্য সম্প্রীতি ও সমবেদনার অমিয় শিক্ষা নিয়ে উপস্থিত হয়। রমজানের শেষে ঈদ উৎসবে যেন সচ্ছল পরিবারের সঙ্গে অভাবী পরিবারের সদস্যরাও অংশ নিতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে বলা হয়েছে বিশেষভাবে। ঈদের আগে সদাকাতুল ফিতর আদায়ের বিধান আনন্দ-উৎসবে সবাইকে শরিক করে নেওয়ার অনুপম ব্যবস্থা। রমজানের শেষ দশকে মুসলিম সমাজে এই আর্থিক কর্তব্যটি পালনে আন্তরিক উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়।
অবশ্য সদাকাতুল ফিতর আদায়ের আরো তাৎপর্য রয়েছে। রমজানের রোজা শেষ করে ইফতার বা রোজাবিহীন কাটানোর সময় ঈদ সামনে রেখে আদায় করতে হয় বলে অর্থ ব্যয়ের এই ইবাদতটির নাম সদাকাতুল ফিতর। আরেকটি তাৎপর্য রয়েছে। গোটা মাস পানাহার ও কামাচার বর্জন এবং পাপাচার পরিহার করে যাওয়া নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ। নাতিদীর্ঘ কালব্যাপী এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারা আল্লাহ তাআলার তাওফিকেই সম্ভব হয়। তাই যখন পবিত্র মাস শেষ হয়ে আসে, তখন আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও তাওফিকের জন্য তার শোকর আদায় করা মুমিনের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। সামান্য পরিমাণে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে মুমিন বান্দারা কষ্টকর ইবাদতটি পালনে সক্ষমতাদানের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে।
সদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য। তবে এ জন্য সক্ষমতার মাপকাঠি রয়েছে। কারো কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তার ওপর ওয়াজিব হয় সদাকাতুল ফিতর আদায় করা। জাকাতের সঙ্গে পার্থক্য এই যে, জাকাতের ক্ষেত্রে প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদশীল হওয়ার শর্ত। কিন্তু সদাকাতুল ফিতরের বেলায় এ দুটি শর্ত নেই। এ জন্য কারো কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থাবর ও অনুৎপাদনশীল সম্পদ থাকলেও এবং শুধু ঈদুল ফিতরের দিনটিতে থাকলেই তাকে সদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। এটা আদায় করতে হয় নিজের ও নিজের পোষ্যদের পক্ষ থেকে। সর্বনিম্ন ৪১ তোলা আটা বা তার মূল্য মাথাপিছু সদাকাতুল ফিতর। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ১১০ টাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এটা ন্যূনতম কর্তব্য। কেউ যদি বেশি পরিমাণে দান করেন তাতে দোষ তো নেই-ই, বরং তা প্রশংসাযোগ্য। দায়মুক্ত হওয়ার জন্য নিম্নতম পরিমাণটি নির্ধারণ করা হয়েছে আদায়কারীদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি বজায় রেখে। অতিরিক্ত আদায় নফল বা ঐচ্ছিক সাব্যস্ত করা হয়েছে এ যুক্তিতে। নিঃস্ব, দরিদ্র আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে এ অর্থ পৌঁছে দেয় কর্তব্য। সেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ব্যয়ের খাতে সদাকাতুল ফিতর ও জাকাতের অর্থ দেওয়া যায় না। তবে ইয়াতিম, দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য তা দেওয়া যাবে। এ জন্যই ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে জাকাত ও সদাকাতুল ফিতর দান করার সুযোগ রয়েছে। যেকোনো ইবাদতে ঈমাণ, ইহতিসাব ও ইখলাস বিবেচ্য। সদাকাতুল ফিতর আদায়ের সময়ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য করলে সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
এমটিআই
© 2025 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | সোনালীনিউজ.কম
Powered By: Sonali IT