ঢাকা : করোনা আক্রান্ত রোগী বেডে যাওয়ায় আইসিইউ বেডের জন্য এক প্রকার হাহাকার পড়েছে। রোগী বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ বেড পর্যন্তও থাকছে না। আইসিইউ না পেয়ে রোগী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে আগের মতো।
চিকিৎসকরা বলছেন, একটি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে নির্ধারিত হাসপাতালের ওয়ার্ডের রোগী পাঠানোর ‘কল’-এর পাশাপাশি হাসপাতালের বাইরে থেকেও অনুরোধ আসছে অনেক। বর্তমান সময়ে শুধু ঢাকা মেডিকেলে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
আর ঢাকার বাইরের আইসিইউ ফাঁকা কেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইসিইউ বিশেষজ্ঞ বলেন, মফস্বলের মানুষের ধারণা, সেখানকার হাসপাতালের চেয়ে ঢাকায় এলে বেটার ম্যানেজমেন্ট, ওষুধ, যন্ত্রপাতি, সিনিয়র চিকিৎসকসহ আইসিইউগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বেশি। যার কারণে তাদের সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে ঢাকায় আসার প্রবণতা বেশি। সুরাইয়া বেগমের বয়স ৬৫ বছর। করোনায় আক্রান্ত সুরাইয়া বেগম বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে নয়টায় মারা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
গত ১০ থেকে ১২ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় কুলিয়ে উঠেতে না পেরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি হন তিনি। সুরাইয়া বেগম ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা লিমার আত্মীয়।
ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক হয়েও আমি এ হাসপাতালের আইসিইউতে একটা বেড ম্যানেজ করতে পারিনি। কারণ বেড ফাঁকা নেই। গত দু-তিন দিন ধরে আইসিইউর জন্য চেষ্টা করছিলাম, ম্যানেজ করতে পারিনি।
প্রচুর রোগী বেড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজেই প্রায় ৩০ থেকে ৩১ শতাংশ রোগী বেড়েছে।
দেশের প্রথম করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, এ হাসপাতালে আইসিইউ বেড রয়েছে ১৬টি, সব বেডে রোগী আছে। আর পাশাপাশি বেড়েছে বেডের জন্য রিকোয়েস্টের চাপ। একই সঙ্গে আইসিইউতে ‘ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর’ সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। গত মাস থেকে এটা শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, আইসিইউতে রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডেও রোগী অনেক বেশি, প্রায় ফুল। ওয়ার্ড থেকে আইসিইউতে রোগী শিফটিংয়ের হারও বেড়েছে।
তিনি বলেন, একই সঙ্গে অনেক বিষয় আছে। যেগুলো হচ্ছে- ওয়ার্ডে ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকেই আইসিইউর রিকোয়েস্ট বেশি থাকছে, আবার হাসপাতালের বাইরে থেকেও আইসিউর জন্য অনুরোধ আসছে অনেক বেশি, কিন্তু সেটা দেওয়া যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অধিদপ্তর ৪ ডিসেম্বর জানানো হয়েছে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা যথাক্রমে ১৬ শয্যা, ১০ শয্যা, ১০ শয্যা ও ১৬ আইসিইউ শয্যার প্রতিটি শয্যায় রোগী রয়েছে।
আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ২২ জন, ফাঁকা রয়েছে দুটি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১১ জন, ফাঁকা রয়েছে চারটি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১১ জন, ফাঁকা রয়েছে পাঁচটি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয়টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন দুজন, ফাঁকা রয়েছে চারটি। আবার তালিকা থাকে সরকারি হাসপাতালের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউর তালিকা দেখানো হয়েছে শূন্য।
মধ্যে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের সাত আইসিইউ শয্যার মধ্যে রোগী আছে সাতজন, আসগর আলী হাসপাতালের ৩১ শয্যাতে রোগী আছেন ২৬ জন, স্কয়ার হাসপাতালের ২৫ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৯ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালের ছয় শয্যার মধ্যে রোগী আছেন পাঁচজন, ইউনাইটেড হাসপাতালের ২২ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৪ জন, এভার কেয়ার হাসপাতালের ২০ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৯ জন, ইম্পালস হাসপাতালের ৫৬ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৩ জন, এএমজেড হাসপাতালের ২১ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৩ জন ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ১২ শয্যার মধ্যে ১২টিতেই রোগী আছেন।
অর্থাৎ ঢাকা মহানগরীর অধিদপ্তরের তালিকাতে থাকা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ রয়েছে ৩১৬টি, যার মধ্যে রোগী আছেন ২২৬ জন, আর শয্যা ফাঁকা রয়েছে ৯০টি।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ১০টি হাসপাতালের ৩৯টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রোগী আছেন ১৬ জন আর ফাঁকা রয়েছে ২৩টি। সারা দেশের অন্যান্য হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে ২১৯টি, যাতে রোগী আছেন ৯২ জন আর ফাঁকা রয়েছে ১২৭টি।
সারা দেশে অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ রয়েছে ৫৭৪টি আর তাতে ভর্তি আছেন ৩৩৪ জন, শয্যা ফাঁকা রয়েছে ২৪০টি।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম বলেন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শুরু থেকেই আইসিইউর চাহিদা ছিল অনেক, মাঝে কিছ দিন সহনীয় অবস্থায় এসেছিল, ওয়ার্ডের রোগীর সংখ্যা কমেছিল কিন্তু আবার আগের মতো অবস্থা শুরু হয়েছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে একদিনও একটা শয্যাও ফাঁকা থাকেনি, যখনি সেটা ফাঁকা হয়েছে তখনই রোগী নিতে হয়েছে। সারা দিন একটা বেড শূন্য ছিল— এটা এখনো হয়নি এ হাসপাতালে। কিন্তু তখন ওয়েটিং যে লিস্টটা সেটা ছোট হয়েছিল।
তিনি বলেন, গত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সেই ওয়েটিং লিস্ট বড় হতে শুরু করেছে, অনেক বড় ওয়েটিং লিস্ট একটা আইসিইউ বেডের জন্য, আমাদের ওয়েটিং লিস্টের খাতাতে একটার পর একটা রোগীর নাম যোগ হচ্ছে।
ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, ওয়ার্ড থেকে যখন আইসিইউর জন্য ‘কল’ হচ্ছে, ‘ওয়েটিং লিস্টে’ থাকা রোগীদের স্বজনদের বলছি, ‘দুঃখিত বিছানা খালি নেই।’ সঙ্গে এও বলে দিচ্ছি, যদি রোগীর ওয়েট করার মতো অবস্থা না হয় তাহলে আপনারা অন্য হাসপাতালে আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারেন কি না দেখেন, যোগাযোগ করেন।
কারণ, আমরা তো তাদের বলতে পারছি না কবে একটা বেড খালি হবে আর কবে সেই রোগীকে আইসিইউতে নিতে পারব। আর ততক্ষণে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে। কারণ আইসিইউতে যে রোগীর জন্য কল দেওয়া হচ্ছে, ওয়ার্ডে তাকে অক্সিজেন দিয়ে পারা যাচ্ছে না বলেই আইসিইউতে কল দিচ্ছে। সেখানে যদি তাকে আরো অপেক্ষা করতে হয় সে তো পারবে না। ফলাফল হিসেবে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
আইসিইউর জন্য ওয়েটিং লিস্টের তালিকাটা কত বড় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৩ থেকে ১৬ জন রোগীর কলও পাচ্ছি আমরা একদিনে। এই যদি হয় কলের অবস্থা, কিন্তু বেড খালি হলে তো একটা অথবা নিদেনপক্ষে দুটা হতে পারে। তাহলে এতজন রোগীকে আমি কোথায় পাঠাব, তাকে অ্যাকোমোডেট করার কোনো ব্যবস্থা নাই।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একই সঙ্গে এই হাসপাতালের ওয়ার্ড ছাড়াও বাইরে থেকে অনেক অনুরোধ থাকে আইসিইউ শয্যার জন্য। কিন্তু আমরা তো আমাদের রোগীকেই নিতে পারছি না, বাইরের রোগীদের কীভাবে নেব? আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেকেই খরচ চালাতে পারেন না, তাই সরকারি হাসপাতালের আইসিইউর চাহিদা অনেক বেশি।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, আজ (৩ ডিসেম্বর) তাদের করোনা রোগী সুস্থ হওয়ার ‘ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল’ করার পরই দ্রুত ছেড়ে দিয়ে নতুন রোগী ভর্তি করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী মারুফ বলেন, যখন সংক্রমণ বাড়ে তখন সংক্রমণ বাড়ার পাশাপাশি ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যাও বাড়ে। তাই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, আইসিইউতে ওয়েটিং লিস্টের তালিকা বড় হচ্ছে দিনকে দিন। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ জন, কোনো কোনো দিন এর চেয়েও আইসিইউ বেডের জন্য কল পাঠানো হচ্ছে; কিন্তু বেড পাওয়া যাচ্ছে না।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ছয় হাজার ৭৭২ জনের।
নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ২৫২ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৭৩ হাজার ৯৯১ জনে।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, ঢাকা সিটিসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন দুই হাজার ৫৭২ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন তিন লাখ ৯০ হাজার ৯৫১ জন। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১১৮টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ১৫ হাজার ৫২৭টি। মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৩০টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ২৮ লাখ ৩৬ হাজার ৪১১টি।
এতে আরো জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার হার ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮২ দশমিক ৪৮ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪৩ শতাংশ।
বিজ্ঞপ্তিতে নাসিমা সুলতানা জানান, ২৪ ঘণ্টায় মৃত ২৪ জনের মধ্যে ২০ জন পুরুষ ও নারী চার জন। এদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিভাগে ১৪ জন, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে দুজন করে চারজন। ময়মনসিংহ বিভাগে তিনজন।
এছাড়া রাজশাহী, সিলেট ও রংপুর বিভাগে একজন করে তিনজন রয়েছেন। এদের মধ্যে হাসপাতালেই মারা গেছেন ২৪ জন।
তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে এসেছেন ১৮০ জন ও আইসোলেশন থেকে ছাড় পেয়েছেন ১৪২ জন। এ পর্যন্ত আইসোলেশনে এসেছেন ৯২ হাজার ১০৬ জন। আইসোলেশন থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৭৯ হাজার ১০৯ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ১২ হাজার ৯৯৭ জন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :