ঢাকা : বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতৃত্বের সংকটে রয়েছে বলে অনেক দিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। কারণ শারীরিকভাবে অসুস্থ দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুই বছরের বেশি সময় রাজনীতি থেকে দূরে আছেন।
অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দণ্ড মাথায় নিয়ে প্রায় আট হাজার মাইল দূরে লন্ডনে বসে দল পরিচালনা করছেন।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বিএনপির বর্ষীয়ান ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ গত মঙ্গলবার মারা গেলেন। ফলে বিএনপিতে নেতৃত্বের আরেক দফা শূন্যতা তৈরি হলো কি না তা নিয়ে দলটির ভেতরে ও বাইরে আলোচনা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, এখন দু-একজন ছাড়া বিএনপিতে জাতীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত আর রইল কে?
মওদুদ আহমদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির চারটি পদ এরই মধ্যে শূন্য হয়েছে। তা ছাড়া তিনি একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন এবং সংসদে সাংবিধানিক যেকোনো ইস্যুতে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএনপি তাঁর ওপরই বেশি নির্ভর করত বলে মনে করা হয়। মওদুদের মতো বড় মাপের নেতা বিএনপিতে কমই আছেন বলেও দলটির বেশির ভাগ নেতাই মনে করেন।
তাঁদের মতে, কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রাজনৈতিক যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো কর্মকৌশল প্রণয়নের সক্ষমতা মওদুদের ছিল। আর এই সক্ষমতার কারণেই প্রথম জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ এবং পরে খালেদা জিয়ার সরকারেও ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে সম্ভবত মওদুদ আহমদই একমাত্র নেতা, যিনি বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—এই দুটি দলেরই প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টি হয়ে আবার বিএনপিতে ফিরতে চাইলে দলটি তাঁর প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করতে পারেনি। এ কারণে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি তাঁকে আবারও দলে জায়গা করে দেয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মনে করেন, মওদুদ আহমদের মতো নেতার মৃত্যুতে বিএনপির যে ক্ষতি হলো তা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ ছিল।
তিনি বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংবিধান ও আইনগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমরা পুরোপুরি তাঁর ওপর নির্ভর করতাম।’ ‘মওদুদ আহমদের ভূমিকা অন্য কেউ পালন করতে পারবে বলে মনে হয় না। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো পটেনশিয়াল তাঁর ছিল’, বলেন বিএনপির নীতিনির্ধারক এই নেতা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার মনে করেন, মওদুদ আহমদের মৃত্যুর ঘটনায় বিএনপির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, মওদুদের মতো পাকা রাজনীতিক শুধু বিএনপিতে নয়, দেশেই কম আছে। তাঁর মতো ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান পাওয়াও কঠিন। এক প্রশ্নের জবাবে সংসদের সাবেক এই স্পিকার বলেন, ‘বিএনপিতে মওদুদ আহমদের অভাব কেউ পূরণ করতে পারবেন না। আইনগত ও সাংবিধানিক বহু বিষয়ে আমরা তাঁর ওপর নির্ভর করতাম।’
বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্র চালানোর লোক কোথায়—এমন প্রশ্ন তুলে প্রবীণ এই নেতা বলেন, ক্ষমতায় গেলে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মতো বাইরে থেকে লোক হায়ার করতে হবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতে, মওদুদ আহমদের মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের অভাব বিএনপি সব সময় অনুভব করবে। কারণ তিনি বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি এটিও সত্য যে হতাশ হলে চলবে না। কারণ কোনো শূন্যতাই চিরকাল অপূরণীয় থাকে না। প্রকৃতির নিয়মেই সেটি পূরণ হয়।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা চলে যায় তারা কিছু লোক রেখে যায়। মওদুদ আহমদের কাছ থেকে আমরা যা শিখলাম উপযুক্ত কাজের মধ্য দিয়ে তার প্রমাণ করা দায়িত্ব আমাদের। ভালো কাজের মধ্য দিয়ে বিএনপিকে আগামীর পথে এগিয়ে নিতে পারলে তাঁর শূন্যতা পূরণ হবে।’
দলটির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে কাগজে-কলমে নেতার সংখ্যা ১৫ জন থাকলেও সক্রিয় মাত্র ১০ জন। এঁদের মধ্যে সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২২ জুন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সেলিমা রহমানকে স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন তারেক রহমান।
লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া অসুস্থ থাকায় অনেক দিন যাবৎ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন না। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বেশ কয়েক বছর যাবৎ ভারতে অবস্থান করছেন। আইনগত জটিলতায় তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না।
মওদুদ আহমদের আগে গত কয়েক বছরের মধ্যে দলটির স্থায়ী কমিটির ১০ জন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি ড. আর এ গনি, ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিগেডিয়ার জে. (অব.) হান্নান শাহ, ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর এম কে আনোয়ার, ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল এম শামসুল ইসলাম এবং ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর এম তরিকুল ইসলাম মারা যান। এর বেশ কয়েক বছর আগে ২০১১ সালের ১৬ মার্চ মারা যান সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং তারও আগে ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের নেতা এম সাইফুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এর আগে ২০০৯ সালের ২০ আগস্ট মারা যান দলটির সাবেক মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার। দলটির সাবেক আরেক মহাসচিব কে এম ওবায়েদুর রহমান মারা যান ২০০৭ সালের ২১ মার্চ।
দলের মধ্যে এসব নেতা দীর্ঘদিন খালেদা জিয়ার সহকর্মী বলে পরিচিত ছিলেন। অনেকে মনে করে, বিএনপির ‘একনিষ্ঠ’ নেতা ছিলেন এঁরাই। জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপিকে এসব নেতার সহযোগিতায়ই খালেদা জিয়া জনগণের মধ্যে নিয়ে গেছেন বলে মনে করা হয়। এই নেতাদের বাইরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিএনপির ডানপন্থী বলে পরিচিত নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া অবশ্য বিএনপি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মান্নান ভূঁইয়া মারা যান ২০১০ সালের ২৮ জুলাই।
জানতে চাইলে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, মওদুদ আহমদের মতো স্মার্ট, বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতা বিএনপিতে কম আছে। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। সেদিক থেকে বিএনপির ক্ষতি হলো বটে। কিন্তু এর পরেও বড় দল বিএনপিতে অনেক নেতা আছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে। নেতৃত্বের শূন্যতা কখনোই অপূরণীয় থাকে না, বলেন বিকল্পধারার এই সভাপতি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :