ঢাকা : বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বগতি। জনগণের অসচেতনতার কারণে সংক্রমণের তীব্রতা না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালমুখী হয় না মানুষ।
এ অবস্থায় রোগীকে বাঁচাতে হাসপাতালে একটি আইসিইউ (হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে) বেড খুবই জরুরি। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় দেশের জেলা শহরের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কোনো হাসপাতালে আইসিইউ সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বেশিরভাগ হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সিস্টেম নেই।
দেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৩৯টিতে এখনো করোনা রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ বেড নেই। এ অবস্থায় গুরুতর রোগীরা অপেক্ষমাণ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, দেশের জেলাগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট নেই। হাসপাতালের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থাও নেই। অথচ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের চিকিৎসার জন্য এই দুটি সিস্টেম প্রধান ভূমিকা রাখে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর গত বছর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিল। প্রায় এক বছর সময় পেয়েও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একাজগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
সরকারি তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে দেশের ২৫ টি জেলার সরকারি হাসপাতালে মাত্র ২৩৯ টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। সে হিসাবে একটি জেলায় গড়ে ১০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। আর ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৩৯ টিতে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ বেড নেই।
কোভিড-১৯ এর জন্য আইসিইউ শয্যাবিহীন হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে-
ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, নেত্রকোণা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড়, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ।
এছাড়া, কোভিড রোগীর একটানা অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার আরেকটি মূল উপাদান হলো একটি হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে, ২৩ টি জেলার সরকারি হাসপাতালে এখনো কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।
সে জেলাগুলো হলো-ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, নেত্রকোণা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড়, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ।
অন্যদিকে রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলো বর্তমানে কোভিড রোগীদের একটি অপ্রতিরোধ্য চাপের মধ্যে রয়েছে। এই দুটি এলাকায় গুরুতর কোভিড রোগীর মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশের বেশি। রাজধানী অনেক হাসপতালে আইসিইউ সাপোর্টের জন্য রোগীর স্বজনরা হাহাকার করছেন।
রাজধানীর মোট ১৩টি সরকারি হাসপতালে মোট ২৪২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এছাড়া কয়েকদিন আগে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল চালু হওয়ার পর থেকে অব্যাহতভাবে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। গত শুক্রবার পর্যন্ত প্রথম পাঁচদিনে সেখানে ১৭৪ রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালটিতে। এসব রোগীর মধ্যে গতকাল শনিবার পর্যন্ত আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৯৮ জন। এ হাসপাতালটিতে এক হাজার আইসিইউ শয্যার ঘোষণা থাকলেও এখন পর্যন্ত ১০০টি শয্যা চালু আছে। আরো ২০০টি আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত থাকলেও জনবলের অভাবে সেগুলো চালু করা যাচ্ছে।
চাট্টগ্রামের ৪টি সরকারির হাসপাতালগুলোর মধ্যে ৪৩টি কোভিড রোগীর জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে। যার সবকটিই রোগীতে পূর্ণ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, ক্রমান্বয়ে কোভিড রোগীর সংখ্যা দেশর বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ছে। এ অবস্থার মোকাবিলার জন্য জেলাগুলোতে প্রস্তুতি খুব কম। যাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বাড়ার আশঙ্ক রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেছেন, ভাইরাসটি এখনও ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশি সংক্রামণ করছে। তবে আগামী দিনগুলোতে এটি দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। তখন এর তীব্রতা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে না বলে আমাদের আত্মতুষ্ট হওয়া উচিত নয়। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে এটা অন্যান্য অঞ্চলে ছাড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।
কোভিড-১৯ এর ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত ন্যাশনাল গাইডলাইনসের সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য মুজিবুর বলেন, সংক্রামণ বাড়ছে। এতে মানুষের মৃত্যুর সংখাও বাড়ছে। কারণ রোগীর তীব্রতার সময় পর্যপ্ত আইসিইউ সেবা দেওয়া যচ্ছে না।
জুলাই ২০১৮ সালে হাইকোর্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেশের সব সরকারি হাসপতালে আইসিইউ শয্যা ও করোনারি কেয়ার ইউনিট স্থাপনের জন্য চাপ দিয়েছে। কিন্তু সংস্থাটি সে অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি।
এই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি আবার আদালত আইসিইউ শয্যা ও করোনারি কেয়ার ইউনিট স্থাপনের আরো ২০ মাসের জন্য সময়সীমা বাড়িয়েছে। আশা করা যায় এ সময়ে মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সবগুলো বিষয় গুছিয়ে আনতে পারবে।
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও জেলাগুলো এখনো চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়নি। ফলে জেলা পর্যায়ে করোনা সংক্রামণ ছড়িয়ে পড়লে সরকারের তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পরবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এবং কোভিড-১৯ সম্পর্কিত জাতীয় প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় উচ্চ আদালত এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও হাসপতালগুলোত করোনা চিকিৎসার সব সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর দায় মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ উদ্দিন মিয়া বলেন, নানা সংকটে সব জেলায় আইসিইউ শয্যা ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থায় সজ্জিত করা যায়নি। তবে এখন প্রতিটি জেলায় জেলায় আইসিইউ এবং কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ সিস্টেম স্থাপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছে। তবে প্রকল্পটি কবে শেষ হবে সে সম্পর্কে তিনি অবশ্য কোনো সময়রেখা দিতে পারেননি।
ফরিদ উদ্দিন আরো বলেন, গত বছরের তুলনায় চিকিৎসা সুবিধাগুলো বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে। যেহেতু কোভিডের কেন্দ্রবিন্দু এখনো ঢাকা ও চট্টগ্রামের দিকে। আর এই দুটি অঞ্চলে বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তাই এ দুই জেলায় আগের থেকে কোভিড চিকিৎসা আরো জোড়ালো হয়েছে। আর আইসিইউ ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহবিহীন জেলাগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :