• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ঈদ ঘিরে সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা


বিশেষ প্রতিনিধি মে ১০, ২০২১, ১১:২৭ পিএম
ঈদ ঘিরে সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা

ঢাকা : স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তোয়াক্কা করছে না কেউ। লোকে লোকারণ্য মার্কেট ও শপিংমল। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গত কয়েকদিন যাবৎ সড়ক ও নৌরুটে গাদাগাদি করে যাতায়াত করছে ঘরমুখো মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বত্র এভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাফেরা এবং অসচেতনতায় বাড়ছে করোনায় সংক্রমণের ঝুঁকি। সাময়িকভাবে সংক্রমণের হার তেমন না বাড়লেও এর প্রভাব পড়বে ঈদ-পরবর্তী জুন মাসের দিকে।

ঈদের বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। রমজানের মধ্যে ঈদের আগে শুক্রবার থেকে রাজধানীর মার্কেটগুলো ছিল লোকে লোকারণ্য। দোকানগুলোর মধ্যে এবং মার্কেটের রাস্তাগুলোতে হাঁটার মতো অবস্থা ছিল না। রমজানের মধ্যে শুক্রবার ও গতকাল শনিবার সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করেছেন ক্রেতারা এমনটাই বলছেন দোকানিরা।

ক্রেতাদের ভিড় বেশি থাকায় এবং বিক্রি ভালো হওয়ায় দোকানিদের মনে কিছুটা স্বস্তি আসলেও কারো মধ্যেই ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা। অধিকাংশ ক্রেতা মাস্ক পড়লেও হয়তো কারো থুতনিতে কিংবা নাকের নিচে নামানো ছিল মাস্ক। মার্কেটগুলোতে ভিড়ের মধ্যে কারো মধ্যেই ছিল না সামাজিক দূরত্ব মেনে অবস্থান করা কিংবা চলাচল করা। ক্রেতাদের এত বেশি সমাগমের কারণে মার্কেটগুলোর সামনের রাস্তাতে দেখা যায় দীর্ঘ যানজট। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গিয়েও বেগ পেতে হয় পথচারীদের।

এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে দূরপাল্লার যানবাহন না চললেও গত কয়েকদিন যাবৎ সড়ক ও নৌপথে দেখা গেছে জনস্রোত। ঈদে কর্মস্থলে থাকার কথা থাকলেও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঘরমুখো হচ্ছেন মানুষজন। আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকায় কয়েক দফা গাড়ি পাল্টে গন্তব্যে যাচ্ছেন তারা। ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলযোগে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করে গন্তব্যে যাচ্ছেন অনেকে। রাতের আঁধারেও চলছে কিছু কিছু গণপরিবহন।

করোনা সংক্রামণ উপেক্ষা করে এক একটি ফেরিতে গাদাগাদি করে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ পার হয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট শাখা সূত্রে জানা যায়, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে দিনে ৬টি ইউটিলিটি (ছোট) ফেরি চলাচল করে। রাতে চলাচল করে ছোট বড় ১৫টি ফেরি।

এরইমাঝে শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ১১ শত পণ্যবাহী ট্রাক ও ১৫ শত ছোট গাড়ি নদী পার হয়েছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জনস্রোত থামাতে গতকাল সকাল ৬টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এতে ঘাটে আটকা পড়ে কয়েক হাজার মানুষ। পরে ঘাটে আটকেপড়া যাত্রীদের বিশেষ বিবেচনায় পারাপার করে কর্তৃপক্ষ। বেলা সাড়ে ১০টার দিকে তিনটি ফেরিতে প্রায় ১১ হাজার আটকে পরা মানুষ পারাপার করে ঘাট এলাকা খালি করা হয়। এরপর এক-দেড় কিলোমিটার দূর থেকে যাত্রীদের ফেরত পাঠানো হয়।

কিন্তু ফেরি চলাচল বন্ধ করেও ফেরানো যায়নি নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মনুষের ঈদযাত্রা। দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে সড়ক পথেও ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে লাখো মানুষ। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক দিয়ে নানাপন্থায় বাড়ি ফিরছেন মানুষ। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় খোলা ট্রাক, পণ্যবাহী ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত ছোট ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হচ্ছেন তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, ১০ বছরের মেয়ে এবং কোলে দেড় বছরের এক ছেলে বাচ্চাকে নিয়ে নিউ মার্কেটের চাঁদনী চকে কেনাকাটা করতে এসেছেন শুভ হাসান এবং তার স্ত্রী। সন্তানদের কারো মুখেই নেই মাস্ক। ক্রেতাদের ভিড়ে দুই সন্তানকে নিয়ে এক প্রকারের বিপদেই পড়েছেন কেনাকাটা করতে এসে।

শুভ বলেন, বাসায় কেউ নেই যে বাচ্চাদের রেখে আসবো। আর ঈদ এলেই তো বাচ্চাদের একটা চাহিদা থাকে নতুন কাপড়ের তাই ওদেরকে নিয়ে বের হয়েছি কিন্তু মার্কেটে এসে এত ভিড় দেখে রীতিমতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছি। এতো ভিড় হবে জানলে হয়তো আসতাম না।

নিউ মার্কেটের কাপড় বিক্রেতা তাসনিম আহমেদ বলেন, গত দুই-তিনদিন ধরে ক্রেতাদের চাপ একটু বেশি। ঈদের আগে শেষ শুক্রবার থেকে ভিড় একটু বেশিই। মার্কেটের মধ্যে কিছুক্ষণ পর পর মাইকিং এবং গার্ডরা সতর্ক করলেও ক্রেতাদের চাপের কারণে স্বাস্থ্যবিধি চাইলেও মানা সম্ভব নয়।

২০১৯ সালের ঈদের আগের বিক্রির মতো শুক্রবার বিক্রি হয়েছে উল্লেখ করে নূর ম্যানশনের কাপড়ের দোকানি দ্বীন ইসলাম বলেন, আজকে মনে হচ্ছে যে কয়েকদিন পরে ঈদ। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক দিতে পারছি না। লকডাউন এবং গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দোকানে খুব বেশি মালামাল আনা হয়নি। তাই অনেক ক্রেতাদেরই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় দিতে না পারায়।

নিউ মার্কেটের চুড়ি বিক্রেতা মাকসুদ আলম বলেন, অন্য ঈদের মতোই শুক্রবার ও শনিবার বিক্রি হচ্ছে। অন্য ঈদে প্রতিদিন ১৭-২০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হতো এখনো এমনটা বিক্রি হবে বলে আশা করছি।

বসুন্ধরা শপিং সেন্টার, মোতালেব প্লাজা, ইস্টার্ন প্লাজা ঘুরে দেখা যায়, শপিংমলের লিফটগুলোতে ছিল মানুষের তীব্র জটলা।  তীব্র গদাগাদি ও অনেকটা প্রতিযোগিতা করেই লিফটগুলোতে চলাচল করছেন কাস্টমাররা। ক্রেতা-বিক্রেতার অনেককেই দেখা গেছে মাস্ক ছাড়া। কারো কারো থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে রাখতেও দেখা গেছে।  

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জোবায়ের আহমেদ সহকর্মীদের সাথে এসেছেন বসুন্ধরা শপিংমলে ঈদের কেনাকাটা করতে। তিনি বলেন, মাস শেষে বেতন পেয়েছি, তাই নিজের বাবা-মা ও ছোট ভাই বোনের জন্যও কিছু পোশাক কিনেছি। দুই-একদিন পর গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম চলে যাব, তাই আজকেই শপিং করতে এসেছি।

স্বামী ও দুই সন্তানসহ কেনাকাটা করতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা হাবিবা আলভি বলেন, কিছু দিন পরে ঈদের মার্কেটে তেমন ভালো মানের জিনিস পাওয়া যাবে না। তাই আজকের ছুটির দিনেই কেনাকাটা করে ফেলেছি। তবে তিনি অভিযোগ করেন জিনিসপত্রের দাম এবার একটু বেশি হাঁকাচ্ছে দোকানিরা।

মার্কেটে ক্রেতাদের সমাগম বেড়ে যাওয়া খুশি বিক্রেতারা। বিক্রিও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন দোকানি।

ইজি ফ্যাশনের বিক্রয়কর্মী রবিউল ইসলাম বলেন,  এবারের ঈদের বাজারে আজকেই বেশি বিক্রি হচ্ছে। সকাল থেকেই দোকানে কাস্টমারের মোটামুটি ভালোই ভিড়। মিরপুর-১ এর মুক্তি প্লাজা, হক প্লাজা ও অল ইন অল ফ্যাশন এন্ড ফেব্রিকস হাউসগুলোতেও দেখা গেছে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। তবে এত ভিড়ের মধ্যেও অনেক ব্যবসায়ী বলছেন যেমনটা বিক্রি হওয়ার কথা ছিল তেমন হচ্ছে না।

মোতালেব প্লাজার এক দোকানি শরিফ ইসলাম বলেন, দোকানে ভিড় আছে কিন্তু বিক্রি ঈদের মতো নেই। দেখা যায় একজনের সাথে পাঁচজন আসছে তাই ভিড় বেশি দেখা যাচ্ছে।

বিস্ময় প্রকাশ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. আব্দুল মালিক বলেন, করোনা সংক্রামণ ঠেকাতে দেশে লকডাউন চলছে। এরই মধ্যে দেশে ছয়জনের দেহে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে। তাদের দুইজনের দেহে ডাবল মিউটেশন পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে এভাবে মার্কেটে ও যানবাহনে চলাফেরা বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। ঈদ ঘিরে এ ধরনের অবাদ চলাফেরা ঈদ পরবর্তী বড় সংক্রামণ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।  

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, শপিংমলগুলোতে ক্রেতাদের এমন অবাধ গমনের জন্য এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাচলের জন্য সর্বপ্রথম সরকারই দায়ী। শপিংমলগুলো এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্র না যে এগুলো বন্ধ থাকলে মানুষ প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে পারবে না। খুলে দিয়েই সবচেয়ে বড় ভুলটি হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, সরকার চাইলেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। এই ভিড়ের কারণে করোনার সংক্রমণ বহুগুণে বাড়বে, তবে এর প্রভাব হয়তো এ মাসে দেখা যাবে না। জুন মাসে গিয়ে এই অনিয়ন্ত্রিত জনসমাগমের জন্য আমাদেরকে ভুগতে হবে।

উল্লেখ্য, প্রথম রমজান থেকেই দেশব্যাপী চলমান সর্বাত্মক লকডাউনে সারা দেশের সব দোকান ও শপিংমল বন্ধ থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে গত ২৫ এপ্রিল থেকে খুলে দেওয়া হয়। এছাড়া গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও গত ৬ মে থেকে সিটির মধ্যে তা পুনরায় চালু করা হয়। বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার বাস, রেল ও লঞ্চ সার্ভিস।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!