ঢাকা : কেবল রাষ্ট্র পরিচালনাই নয়, ব্যক্তি থেকে শুরু একটি দেশের প্রায় প্রতিটি বিষয়ে রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থাকে। তবে অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসূত্রটা যেন অন্যসব উপাদানের অনেক বেশি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ফলে রাজনীতির আকাশে মেঘ থাকলে তা অর্থনীতিকেও মেঘাচ্ছন্ন করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এবং পরে দীর্ঘদিন ধরে সরকারবিরোধী হরতাল-অবরোধের আন্দোলনে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার বিরোধীদের টানা সহিংস আন্দোলনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দেশের অর্থনীতি।
বৈদেশিক বিনিয়োগ না আসা ও রপ্তানিতে ধসনামা অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাবের কারণে দেশে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে ২০১৬ সালের পর ধীরে ধীরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীল ফিরতে শুরু করলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন সূচকেও ইতিবাচক ধারা ফিরে আসতে থাকে।
তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে বিরোধীদলের সহিংস রাজনীতি না থাকলেও দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
তাদের মতে, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। সেটি অনুপস্থিত থাকায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কমে যাওয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বাড়ছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক কাঠামো না থাকার কারণে অর্থনীতিকে মূল্য দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘যখন দেখি অহেতুক প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বেড়ে যায়, নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ যখন শেষ হয়না, আবার যে মানের প্রকল্প, সেই প্রকল্প থেকে যে ধরনের রিটার্ন আসার কথা সেটা যখন আসেনা তখন প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির অনুপস্থিতিটা টের পাওয়া যায়।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, বর্তমানে রাজনীতিতে একটা অনিশ্চয়তা এবং অচলাবস্থা চলছে। এটা আমাদের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে অচলাবস্থা থাকলে বিনিয়োগ আসেনা। কারণ, অচলাবস্থার কারণে ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগ করতে ভয় পায়। তারা তখন বিদেশে টাকা পাচার করতে উৎসাহী হয়। এটা হচ্ছে আমাদের দেশের প্রকৃত অবস্থা। আর আমাদের গভর্নেন্স সিস্টেম ভেঙ্গে গেছে। এসব বিষয় অর্থনীতিতে চরমভাবে প্রভাব ফেলছে।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে অহেতুক সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি অহেতুক প্রকল্প বিলম্বিত করে শেষ মুহূর্তে প্রকল্প সম্প্রসারণের যেন হিড়িক পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভাগগুলোতে প্রকল্প সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ ঘুরেফিরে তাদের হাতেই যায়। এই সিন্ডিকেটের কারণে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সিন্ডিকেট চক্রটি প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর বাড়াতে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করে সময়ক্ষেপণ করে।
একারণে বছরের প্রথম ৬ মাসে তেমন কাজ না হলেও শেষার্ধে তাড়াহুড়ো করে বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ছাড় করা হয়। বছরের শেষ মাসে এমনকি শেষদিনও বিপুল অর্থ ছাড়ের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে বেশিরভাগ প্রকল্পেই এই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, রাজনৈতিক নজরদারির অভাবে এ ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি হচ্ছে। কারণ, রাজনৈতিক নজরদারি অনেকটা সামাজিক নজরদারির মতো। রাজনৈতিক নজরদারি থাকলে সরকারও এর সুফল পেতো।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কাজ পাচ্ছেনা। বিভিন্ন রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে সেই চিত্র দেখা যাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি। একটা প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো থাকলে এ ধরনের সিন্ডিকেটের কোনো সুযোগ থাকতো না। থাকলেও সেটা সহজেই ধরা পড়তো। এসব যখন হচ্ছে তখন দেখা যায় কেউ কেউ এ কাজে প্রভাবিত করছে কিংবা অনৈতিকভাবে সুবিধা দিচ্ছে। সেকারণে এগুলো গড়ে উঠার সুযোগ পাচ্ছে।
এটা এক জায়গা থেকে হচ্ছে না, ভেতরে এবং বাইরে সব জায়গায় থেকে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর দ্বারা হচ্ছে। সেখানে কেউ যদি ভয়েস রেইস করার সুযোগ থাকতো তাহলে এগুলো কম থাকতো।’
অন্যদিকে, সুজন সম্পাদক মনে করেন, ক্ষমতা বদলের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ উপায় হলো নির্বাচন। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়ছে। এতে ব্যবসায়ীরা বড় বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে সহিংসপন্থায় ক্ষমতাবদলের পথ প্রশস্ত হয়। এতে রাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়ছে। এই রাজনৈতিক ঝুঁকি অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।’
সিপিডির গোলাম মোয়াজ্জেম বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধে সরকারের করণীয় সম্পর্কে বলেন, ‘সরকার একটা অডিট সিস্টেম রাখতে পারে যেটা সরকারের বাইরে থেকে নজরদারির সুযোগ থাকবে। যেমনটি বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোতে রয়েছে এবং আমাদের দেশেই সেটা রয়েছে। এ ধরনের একটি ম্যাকানিজ থাকা দরকার।
এছাড়া, যাদের জন্য অর্থাৎ জনগণের জন্য যে প্রকল্প করা হয় সেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
অর্থাৎ, কোনো এলাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রাখা।
এছাড়া, যেসব প্রকল্পের কাজ হচ্ছে সেগুলোর যাবতীয় তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।’
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :