ঢাকা : দেশজুড়ে কঠোর লকডাউনের সময় যতই গড়াচ্ছে, ততোই বিধিনিষেধের ভীতি কমছে সাধারণ মানুষের। গত বৃহস্পতিবার লকডাউনের প্রথমদিন রাস্তাঘাটে গাড়ি কিংবা সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল বেশ কম। কিন্তু দিন যতই গড়াচ্ছে রাস্তায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কঠোর লকডাউন বা করোনা কোনো কিছুই আটকাতে পারছে না সাধারণ মানুষকে। তাই মূল রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতি কম থাকলেও পাড়া-মহল্লায় সব ধরনের দোকানপাট খোলা রয়েছে। থাকছে সাধারণ মানুষের জটলা।
লকডাউনের চতুর্থদিন রোববার (৪ জুলাই) সকালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান সড়ক মোটামুটি ফাঁকা থাকলেও অলিগলি ও কাঁচাবাজারে মানুষের ভিড় আগের তিন দিনের চেয়ে অনেক বেশি। কারো কারো মাস্ক ঝুলছে থুতনিতে। কাঁচাবাজার, মাছের দোকানে গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দরদাম চলছে; গলির ভেতরে খাবার হোটেলে নাস্তা কেনার জন্য জটলা করছেন অনেকে।
বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলছেন, সরকার ঠিকই কঠোর লকডাউন দিয়েছে কিন্তু পাড়া-মহল্লায় এর কোনো চিহ্নই নাই। নিত্য প্রয়োজনীয় দোকানের বাইরেও সব ধরনের দোকানপাট খোলা রয়েছে। লোকজনও চলাচল করছে। তিনি বলেন, লকডাউনের ভীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে একেবারেই নাই।
আজিমপুর চৌরাস্তায় আগের তিন দিনের তুলনায় অনেক বেশি পুলিশ সদস্য দায়িত্বে ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া কাউকেই তারা রাস্তা দিয়ে যেতে দিচ্ছেন না।
পলাশী মোড়ে তল্লাশি চৌকি না থাকলেও রয়েছে পুলিশের তৎপরতা। তেজগাঁও এলাকায় ভোর থেকেই সেনা সদস্যরা তৎপর ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সড়ক ধরে টহলও দিতে দেখা গেছে তাদের। শাহবাগ এলাকায় দেখা গেছে র্যাব ও বিজিবির টহল।
আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের সামনের সড়কে দেখা গেল এক মাছের দোকানে ১৫ জনের মতো মানুষের ভিড়। একজনের শরীরের সঙ্গে আরেকজনের শরীর লেগে আছে। কাছেই দুটো খাবার হোটেলে ভিড় করে নাস্তা কিনছে মানুষ। পল্টন, মালিবাগ, আজিমপুর, মিরপুর, ধানমণ্ডি,শাহবাগসহ প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহনের সংখ্যাও গত দুদিনের তুলনায় বেশি।
লকডাউনে সব সড়কেই এখন চলছে রিকশা। জরুরি পরিষেবা ও পণ্যের গাড়ি ছাড়া সব ধরনের যান্ত্রিক বাহনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রিকশা চলতে বাধা নেই। রামপুরা-মালিবাগ এলাকার প্রধান সড়কের পাশের দোকানপাটগুলো বন্ধ থাকলেও সকালে গলির ভেতরে সেলুন, মোবাইল এক্সেসরিজ, চায়ের দোকানসহ সব ধরনের দোকানই খোলা দেখা যায়।
শনিবার রামপুরা কাঁচা বাজারের পাশে সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে পুলিশের তল্লাশি চৌকি ছিল, তবে রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত তা দেখা যায়নি। ছোটখাটো দুর্বল শরীরের মধ্য বয়সী এক নারীকে মৎস্য ভবনের সামনের সড়ক দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায় সকালে। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে বললেন, কাকরাইলে এক বাসায় কাজ করেন, সেখানেই যাচ্ছেন।
লকডাউনে বের হয়েছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মালিকতো ছুটি দেয়নি। দিলে তো চাঁনখারপুল থেকে আসতে হতো না।’
বৃষ্টির কারণে মিরপুরের ১১, ১২ ও কালশী এলাকার সড়কগুলোতে চলাচল কম ছিল সকালে। তবে মুদি দোকান ও কাঁচাবাজারে মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। বাজার করতে বের হয়েছেন তাদের অনেকে।
মিরপুরের মুসলিম বাজারের সবজি বিক্রেতা ডালিম বলেন, ‘সকালে কিছু বিক্রি হইছে। এখন বৃষ্টি বাড়ছে, তাই কাস্টমার কম। যাদের দরকার, তারা তো কিনবই।’
পূরবী বাসস্ট্যান্ডে যানবাহনের অপেক্ষায় ছিলেন মহসিন হোসেন নামের একজন। তিনি বললেন, ‘বৃষ্টির মধ্যে সিএনজি পেলে ভালো হতো। কিন্তু লকডাউনে তো সে উপায় নেই। জরুরি কাজে ফার্মগেট যাব, রিকশা এতদূর যেতে চাচ্ছে না। এখন ভেঙে ভেঙে যেতে হবে।’
বিধিনিষেধ মানাতে সকালে বেগম রোকেয়া এভিনিউয়ে পুলিশের গাড়ি টহল দিতে দেখা গেছে। বৃষ্টির কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছিলেন পুলিশবক্সে। মাঝে মধ্যে প্রাইভেট কার থামিয়ে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
কাকরাইল, শান্তিনগর, পল্টন ও ফকিরাপুলের রাস্তায় প্রচুর রিকশা থাকলেও অধিকাংশই খালি। রিপন নামের এক রিকশাচালক বললেন, ‘আমার খোরাকিও লকডাউনে পড়ছে। ভোরে রিকশা নিয়ে বাইর হইলেও যাত্রী পাওয়া যায় না। মালিকদের কী দেব আর নিজে কী খাব।’
এদিকে সরকার ঘোষিত সাতদিনব্যাপী কঠোর লকডাউনের চতুর্থ দিন গতকাল রোববারও বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হলে জরিমানা এবং গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। তবে জরুরি পরিষেবায় নিয়োজিতরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তল্লাশির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়ে গন্তব্যে বা কর্মস্থলে যেতে পারছেন।
চলমান কঠোর লকডাউনকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে চেকপোস্ট পরিচালনা করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ক্রাইম ও ট্রাফিক ডিভিশন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসব চেকপোস্টে প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, রিকশা বা অন্যান্য ব্যক্তিগত গাড়ির আরোহীদের গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি পুলিশের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলে যেতে দেওয়া হচ্ছে। যারা অযৌক্তিক কারণে বাইরে বের হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি ট্রাফিকের আটটি বিভাগ আছে। মতিঝিল, তেজগাঁও, ওয়ারী, মিরপুর, উত্তরা, গুলশান, রমনা ও লালবাগ—এই আটটি ট্রাফিক বিভাগকে দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছে ডিএমপি। সদর দপ্তরে সহায়তায় প্রয়োজনীয় ফোর্স নিয়ে লকডাউনকে কেন্দ্র করে চেকপোস্টগুলোতে ট্রাফিক সার্জেন্টের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করছে তারা। নিরাপত্তা এবং বাইরে বের হওয়ার বিষয়টি তদারকির জন্য সার্জেন্টরা চেকপোস্টের দায়িত্বে রয়েছেন। তাদের মনিটরিংয়ের জন্য রয়েছেন ট্রাফিক ইনস্পেক্টর।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডিসি, এডিসি ও এসিরা তল্লাশির বিষয়টি মনিটরিংয়ের জন্য যে কোনো সময় যে কোনো চেকপোস্ট পরিদর্শন করছেন। এতে করে পুলিশ সদস্যরাও আরও বেশি কাজের বিষয়ে সিনসিয়ার থাকছেন।
মোহাম্মদপুর জোনের ট্রাফিক সার্জেন্ট মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত শিফটিং করে বিভিন্ন সড়কে ডিউটি করছি। চেক পোস্টগুলোতে সবসময়ই পুলিশ সদস্যরা থাকছেন। তবে মাঝে মাঝে দেখা যায় চেক করতে গিয়ে গাড়ির জ্যাম লেগে যায়।’
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার শাহেদ আল মাসুদ বলেন, ‘তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের ৬টি চেকপোস্ট পরিচালিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি ক্রাইম ডিভিশনও চেকপোস্ট পরিচালনা করছে। মহাখালী থেকে ফার্মগেট আসার পথে জাহাঙ্গীর গেটে, আগারগাঁও হেলিপ্যাডের ওখানে, বিজিপ্রেস এলাকায়, সাতরাস্তার মোড়ে, নাবিল ক্রসিংয়ে, কলেজ গেটের সামনে নিরাপত্তা তল্লাশি পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন সড়কে প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে আমরা চেকপোস্ট পরিচালনা করছি। যে রাস্তায় যানবাহন চলাচল বেশি করছে, সে রাস্তায় আমরা চেকপোস্ট পরিচালনা করছি।’
গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘গুলশান, বাড্ডা, বনানী এলাকায় ক্রাইম ডিভিশনের পক্ষ থেকে ২২টি চেকপোস্ট পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগ চেকপোস্ট পরিচালনা করছে। তবে আজ গাড়ির চাপ কিছুটা বেশি দেখা গেছে। ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল বেড়েছে।’
এদিকে গতকাল রোববার ডিএমপিতে ৬১৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মোবাইল কোর্টে ১৬১ জনকে ৫৪ হাজার ৪৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ডিএমপি ট্রাফিক কর্তৃক ৪৯৬ টি গাড়িকে ১২ লাখ ৮১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :