ঢাকা : প্রতিদিন রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যু। তবুও সর্বত্র উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) থেকে স্বাস্থ্যবিধি শিথিল করায় দৃশ্যত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরেছে দেশ। পাল্টে গেছে রাজধানীর চিত্র।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) সকাল থেকেই রাস্তাঘাটসহ মার্কেট, লঞ্চ, বাস ও রেল স্টেশনসহ সব জায়গাতেই দেখা গেছে মানুষের বেপরোয়া চলাচল। কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণকে উপেক্ষা ঈদ পরবর্তীসময়ে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সবকিছু এমন ঢিলেঢালা চললে ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তারা।
এদিকে বুধবার (১৪ জুলাই) মধ্যরাত থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করায় রাজধানী থেকে প্রায় দেড় মাস পর ছেড়ে যায় দূরপাল্লার বাস। ভোর থেকে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় নানা গন্তব্যের ট্রেন।
এছাড়া সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ছেড়েছে লঞ্চও। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গতকাল থেকে খুললেও সব ধরনের জনসমাগম ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, অর্ধেক আসন খালি রেখে যাত্রী বহনের কথা থাকলেও অনেক বাসে দেখা গেছে পুরো আসনের যাত্রী বহন করতে। কোনো কোনো বাসে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধিও।
আর ভোরের আলো ফোটার আগেই কমলাপুর রেল স্টেশনে দেখা যায় ঘরমুখো মানুষের ভিড়। দুই সপ্তাহ ধরে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে রাজধানীতে আটকে থাকা অনেকেই বাড়ি ফিরছেন। আবার পরিবারের সাথে ঈদ উদ্যাপন করতে আগে ভাগেই যাচ্ছেন কেউ কেউ। ফলে টিকিট কাউন্টারগুলোতে দেখা যায় টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইন।
এছাড়া গতকাল ভোর থেকে শুরু হয়েছে লঞ্চ চলাচল। সারাদিনই সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ছেড়ে গেছে বিভিন্ন গন্তব্যের লঞ্চ। বিধিনিষেধ শিথিলের প্রথম দিনই সদরঘাটে যাত্রীদের ব্যাপক চাপ দেখা যায়। তবে সব ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি।
গণপরিবহনে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ করা হলেও তা মানছেন না কেউ। সরকারের নির্দেশনায় কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না গণপরিবহনের মালিক ও শ্রমিকরা। স্বাস্থ্যবিধি তো দূরের কথা, ঝুঁকি নিয়ে বাস-মিনিবাসে চলাচল করতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষকে। লঞ্চ পরিবহন ব্যবস্থায়ও একই চিত্র।
অন্যদিকে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শই মানছে না সরকার। আগে থেকেই চলতি জুলাই মাসকে ‘কঠিন’ বলে আখ্যায়িত করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধিদপ্তর বলছে, জুনে যত রোগী শনাক্ত হয়েছিল, তার থেকে বেশি পরিমাণ শনাক্ত হয়েছে জুলাইয়ের ১৫ দিনে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর এ গতি আরো বাড়বে যদি সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া না হয়। এ অবস্থায় পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ করেছিল অধিদপ্তর। কিন্তু শনিবার (১৭ জুলাই) থেকে রাজধানীতে বসছে হাট।
গত ২৪ ঘণ্টায় (১৫ জুলাই) দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২২৬ জন। এ নিয়ে টানা পঞ্চম দিনের মতো দেশে একদিনে মৃত্যু ২০০-এর বেশি। ১৪ জুলাই মারা গেছে ২১০ জন।
১৩ জুলাই মারা গেছে, ২০৩ জন। ১২ জুলাই ২২০ জন ও ১১ জুলাই ২৩০ জনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ মৃত্যুই জানান দেয় দেশের করোনা পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
যখন করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে হিমশিম অবস্থা।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, এর মধ্যেই চোখ রাঙাচ্ছে মারণ ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা।
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ মহলের আশঙ্কা, অসাবধানতার সুযোগে তৃতীয় ঢেউয়ে সব জনগোষ্ঠীর, সব বয়সের মানুষের মধ্যেই সংক্রমিত হতে পারে। বিশেষ করে শিশুরা আগের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হতে পারে। তাই এই পরিস্থিতিতে সাবধান না থাকলে সামনে বিপদের মোকাবিলা করতে হবে সকলকেই।
করোনার থাবা মারাত্মক রূপ নিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা তেমন দেখা যাচ্ছে না। সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না তারা। অলিগলি সর্বত্রই মানুষের জটলা। স্বাস্থ্যবিধি মানতে সরকারের উদ্যোগও তেমন চোখে পড়ছে না।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ঢাকার বাইরে যেভাবে সংক্রমণ বেড়েছিল ঠিক একইভাবে ঢাকায়ও সংক্রমণ বাড়ছে। আমরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছি। কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছি না।
তাই আশঙ্কা করছি, মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা না করে চলাফেরা করছে, তাতে সামনের দিনগুলো এ সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, এখন সংক্রমণের গতি দেখে মনে হচ্ছে আগস্টের আগেই তৃতীয় ঢেউ ঘটে যাবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা, কোভিড পরীক্ষা বাড়ানো ও সংক্রমিত ব্যক্তিদের অন্যদের থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে হয়। সবাইকে সম্পৃক্ত করে কাজ করার পরমর্শ দেন তিনি।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশেই শনাক্তের হার বেড়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এবার গ্রামের মানুষের মধ্যেও সংক্রমণ দেখা গেছে। এই ভাইরসে ধনী-গরিব বলে কোনো কথা নেই। সব জনগোষ্ঠীর, সব বয়সের মানুষের মধ্যেই সংক্রমিত হতে পারে অসাবধানতার সুযোগে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, অজানা সংক্রমণের উৎসটিকে বন্ধ করতে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
সাধারণ মানুষ যদি মনে করেন গরিব মানুষের করোনা হয় না, করোনা হয় বড় লোকের। তাহলে বড়লোকের জীবন বাঁচাতে গরিব লোকের পকেটের পয়সা খরচ করে কেন মাস্ক কিনবে। যারা পকেটে টাকা থাকার পরেও মাস্ক কিনে পরছে না তাদের জরিমানা করতে হবে। এতে করে সচেতনতা বাড়বে। মাস্ক পরা যেহেতু স্বাস্থ্যবিধির অংশ, তাই প্রচারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সামান্য উপেক্ষা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই এখন থেকেই সতর্ক থাকার অনুরোধ করিছ। করোনার সঙ্গে বসবাসের অভ্যাস রপ্ত করতে হবে আমাদের সবাইকে।
করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষ যেভাবে চলাফেরা করছে তাতে সামনে বড় বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, মাস্ক ব্যবহার করতে যত বেশি নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তত বেশি তা লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়ছে। সরকার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই যাচ্ছেন। রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও জনাকীর্ণ স্থানগুলোতে মানুষের চলাফেরা অনেকটাই করোনা পূর্বের স্বাভাবিক সময়ের মতোই।
জনগণ কথা শুনছে না বা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, এটা বলে কিন্তু দায়িত্ব শেষ করার সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্বটা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোরতা ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ একান্তই কাম্য বলে তিনি মনে করেন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :