• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

পিছিয়ে পড়ার কারণ ‘আত্মতুষ্টি’


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ২, ২০২১, ০১:২২ পিএম
পিছিয়ে পড়ার কারণ ‘আত্মতুষ্টি’

ঢাকা : পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ টপকে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে চলে গেছে ভিয়েতনাম।

কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের এই উত্থান এবং বাংলাদেশের অবনতি একদিনে হয়নি। ২০ বছর ধরে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু মৌলিক উদ্যোগ নিয়েছে।

বিপরীতে বাংলাদেশ সেসব উদ্যোগ নেওয়ার বদলে কেবলমাত্র মার্কেট এক্সেস সুবিধার ওপর নির্ভর করে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছে। এ কারণে ক্রমেই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২১-এর প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের বিপরীতে ভিয়েতনামের অবস্থান ছিল অনেক নিচে।

২০১০ সালে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ভিয়েতনামের ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। কিন্তু মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে বাংলাদেশকে টপকে যায় ভিয়েতনাম। গত বছর বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশে।

অর্থাৎ ২০২০ সালে ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির বিপরীতে বাংলাদেশ করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। অথচ এর আগের বছরেও বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে ৩০০ কোটি ডলার অতিরিক্ত রপ্তানি আদেশ পেয়েছিল।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নে গত ২০ বছরে তেমন কোনো মৌলিক কাঠামো তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যে কারণে ক্রমেই বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে।

যার মধ্যে অন্যতম হলো-পণ্যের বহুমুখীকরণকে গুরুত্ব না দেওয়া, নন-কটন পণ্য উৎপাদন না করা, বিদেশি বিনিয়োগ না থাকা, এনভায়রনমেন্টাল কমপ্লায়েন্সে সমস্যা, প্রযুক্তির আপগ্রেডেশনকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং মুক্ত বাণিজ্য সহযোগিতা চুক্তি না থাকাসহ আরো বেশ কিছু অনুষঙ্গ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা এতদিন টিকে থাকার আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলাম। সেটা থেকে বের হয়ে আসার সময় এসেছে। মার্কেট এক্সেসের সুবিধা নিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না।

এখন আমাদের দরকার প্রযুক্তিগত আপগ্রেডেশন, সোশ্যাল আপগ্রেডেশন, পণ্যের বহুমুখীকরণ, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি, অনলাইন বেইজড মার্কেটিং বাড়ানোর পাশাপাশি দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এতদিন যেটুকু অ্যাডভান্টেজ ছিল সেটুকু ধরেই এগিয়েছি। এর মাধ্যমে আগামী দিনে এগোনো যাবে না।’

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, পোশাক শিল্পে ভিয়েতনামের উত্থানের বড় কারণ হলো-তাদের বহুমুখী পণ্যের উৎপাদন সক্ষমতা। কটন, নন-কটন পণ্য উৎপাদন করছে তারা। দেশটিতে ব্যাপকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে এবং তারাই ভিয়েতনামের ইন্ডাস্ট্রির একটি বড় শক্তি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে।

এছাড়া ভিয়েতনামের কমপ্লায়েন্স বাংলাদেশের তুলনায় অনেক উন্নত এবং শ্রমিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও বেশি। এসব কারণে তাদের উৎপাদন সক্ষমতাও বেশি।

অন্যদিকে দেশটি আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সে পেয়ে থাকে। পাশের দেশ চীন থেকে কম সময়ে সহজেই কাঁচামাল পেয়ে থাকে তারা। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশের সাথে ভিয়েতনামের বাণিজ্য সহযোগিতা অনেক শক্তিশালী। এসব কারণে তারা ধীরে ধীরে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, করোনার কারণে গত বছর প্রায় এক মাস পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় তখন পণ্য রপ্তানি হয়নি। অনেক ক্রয়াদেশও বাতিল হয়েছে। এরপর কারখানা খুললেও ক্রয়াদেশ কম ছিল। সেজন্য ভিয়েতনাম সহজেই বাংলাদেশকে পেছনে ফেলতে পেরেছে।

এদিকে বাংলাদেশকে চোখ রাঙাচ্ছে সুলতান সুলেমানের দেশ খ্যাত তুরস্কও। বাংলাদেশ যেমনি ভিয়েতনামের কাছে অবস্থান হারিয়েছে, তেমনি তুরস্কের কাছে নিজেদের চতুর্থ অবস্থান হারিয়েছে ভারত। গত বছর ভারত ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার রপ্তানি করলেও তুরস্ক করেছে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। যদিও ২০১৯ সালে ভারতের রপ্তানি ছিল ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। আর তুরস্কের ছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ যদি তার দ্বিতীয় অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে তুরস্কের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে। আর এই লড়াই খুব সুখকর হবে না বলে মনে করছেন তারা।

কারণ, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাকেনজি অ্যান্ড কোম্পানির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্যাশন ধারার দ্রুত পরিবর্তনশীলতার কারণে দূরের দেশ থেকে পণ্য এনে ক্রেতার চাহিদা পূরণ করা কষ্টকর হয়ে উঠছে। তাই ক্রেতাদের কাছে দ্রুততর সময়ে পণ্য পৌঁছে দিতে তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলো কাছাকাছি জায়গা থেকে পোশাক ক্রয় করবে। ম্যাকেনজি অ্যান্ড কোম্পানি পোশাক শিল্প খাতের ১৮৮ জন প্রতিনিধির ওপর জরিপটি পরিচালনা করে।

সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ৭৯ শতাংশ নির্বাহী বলেছেন, ২০২৫ সাল নাগাদ দ্রুততার জন্য কাছাকাছি জায়গাকে প্রাধান্য দেওয়া হতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কিংবা চীন থেকে জিন্স উৎপাদন করতো, তারা মেক্সিকোর দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে কিংবা সেখানে উৎপাদন বাড়িয়ে দিতে পারে। আর ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর জন্য এখনো বাংলাদেশ থেকে পোশাক নেয়া সাশ্রয়ী। এখানে উৎপাদন খরচ অনেক কম। তবে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন চীন থেকে তুরস্কে স্থানান্তর করা হলে তাতে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য পাওয়া যাবে। তাই তুরস্ক ক্রমেই বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।

যদিও রপ্তানিকারকরা বলছেন, চলতি বছরের মধ্যেই ভিয়েতনামকে টপকে বাংলাদেশ আবারো পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান সুসংহত করতে সক্ষম হবে। কারণ বর্তমানে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। অনেক কারখানা ২০১৯ সালের চেয়ে ৫-১০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি পাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘করোনার কারণের গত বছর এপ্রিলে প্রায় এক মাস আমাদের কারখানা বন্ধ ছিল। কিন্তু ভিয়েতনামের উদ্যোক্তাদের মহামারির মধ্যে একদিনের জন্যও কারখানা বন্ধ রাখতে হয়নি। এ কারণে তারা বাংলাদেশকে টপকে যেতে সক্ষম হয়েছে।’

তিনি ভিয়েতনামকে বাংলাদেশের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘করোনার ধাক্কা কাটিয়ে বিপুল ক্রয়াদেশ আসছে। চলমান বিধিনিষেধে যে কয়েকদিন কারখানা বন্ধ ছিল, তাতে খুব একটা সমস্যা হবে না। তাই আমার প্রত্যাশা, চলতি বছর আবার বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে চলে যেতে পারবে।’

তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন বেশি করে ক্রয়াদেশ পাওয়ার মাধ্যমে সাময়িকভাবে দ্বিতীয় অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে পারলেও দীর্ঘ মেয়াদে সেই অবস্থান ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জের। তাই যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত কার্যক্রর উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন তারা।

এ প্রসঙ্গে সিপিডি’র গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অবস্থান পুনরুদ্ধার সম্ভব। কারণ বাংলাদেশ বাল্ক পরিমাণ পোশাক তৈরির কাঠামো রয়েছে। ইপিজেডগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে আইটি সিস্টেম অনলাইনভিত্তিক প্লাটফর্মের মাধ্যমে বিক্রি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া।

নন-কটন পণ্যের উৎপাদনে বিনিয়োগ করা, যেটা একেবারেই নেই। প্রয়োজনে সরকারের পলিসি পরিবর্তন করা। নন-কটন পলেস্টার সিথেটিক ফাইবার উৎপাদনে পোশাকশিল্পের অন্যান্য খাতে যেসব ইনসেনটিভ দেওয়া হয় সেগুলো নন-কটন খাতে দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকে সুযোগ করে দেওয়া।’

তার মতে, আমাদের দেশি বিনিয়োগকারীদের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে এক ধরনের অনীহা রয়েছে। সেই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে তাদেরকে।  

কারণ, এরই মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি গ্রাজুয়েশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এক সময় বাংলাদেশের জন্য ডিউটি ফ্রি সুবিধা থাকবে না। তাই আগামী ৪ থেকে ৫ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এই অর্থনীতির গবেষক।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!