ঢাকা : রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় ফুটপাতে বসে কিছু লেবু, কাঁচামরিচ আর ধনেপাতা বিক্রি করছিলেন শরিফ মিয়া।
কেমন চলছে জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, দৈনিক দু-তিনশো টাকা আয় হয়, তা দিয়ে ডালভাত খেয়ে বাঁচাটাও দায় হয়ে পড়েছে।
অনেক ক্ষোভ আর অভিমানের সঙ্গে বললেন, ‘আসলে আমাদের মতো মানুষদের খোঁজ নেওয়ার কেউ। সারাদিন খাওয়ার মধ্যে খাই তিনবেলা ভাত। বাড়তি খাবার তো আর কপালে জুটে না। কিন্তু সেই চালের যে দাম! তা নিয়ে আর কি বলবো? কার কাছে বলব।’
শরিফ মিয়ার মতো করোনায় কর্মহীন হয়ে কিংবা সামান্য আয় রোজগারের মানুষেরা এমনিতেই অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের যেটুকু সঞ্চয় ছিল তাও ফুরিয়ে গেছে। নুন আনতে পানতা ফুরোনো এসব মানুষ এখন আর আয়েশি জীবন নয়, বরং পেটপুরে দু-বেলা দু-মুঠো ভাত পেলেই খুশি। কিন্তু এমন দুঃসময়ে দফায় দফায় চালের দাম বৃদ্ধি তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলছে।
চালের মূল্য বৃদ্ধি এবং সরকারের মজুত কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গতবছর থেকে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এজন্য তুলে দেওয়া হয় আমদানি শুল্কও। পাশাপাশি চলতি বোরো মৌসুমে বিপুল পরিমাণ ধান মজুতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চালের দাম কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে হয়েছে উল্টো। দফায় দফায় বেড়ে চলেছে চালের দাম।
উদ্বেগজনক দিক হলো, প্রতিবছর বোরো মৌসুমে দেশে চালের দাম অনেকটাই কমে যায়। কারণ, এ মৌসুমে মোট চালের ৫৫ শতাংশের বেশি উৎপাদিত হয়। এবার দাম তেমন একটা কমেনি, বরং মৌসুম শেষ না হতেই বাড়ছে। ফলে এ নিয়ে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে(২০১০-১১ অর্থবছর) প্রতিকেজি (মাঝারি মানের) চালের গড় দাম ছিল ৪১ টাকা। গত অর্থবছরও (২০১৯-২০) প্রতিকেজি চালের গড় দাম ছিল ৫৬ টাকা। বর্তমানে গড়ে প্রতিকেজি চাল ৬০ টাকারও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার প্রতিকেজি সরু চালের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৮ টাকা, মাঝারি চাল ৫০ থেকে ৫৮ এবং মোটা চাল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। অথচ ২৫ জুলাইয়ের আগে প্রতিকেজি সরু চালের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৬ এবং মোটা চাল ৪৬ থেকে ৫০ টাকা।
এদিকে, সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে খোলাবাজারে বিক্রয় বা ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) পাশাপাশি গত ২৫ জুলাই থেকে বিশেষ ওএমএস দিচ্ছে সরকার। এরপরও বাজারে চালের দাম কমছে না।
এছাড়া, চলমান বোরো মৌসুমে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে কিনা, তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে বোরো সংগ্রহের সময়সীমা আরো ১৫ দিন বাড়িয়েছে সরকার। যদিও ওএমএসসহ নানা কর্মসূচিতে চাল বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত ফেব্রুয়ারির মতো বেসরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
চলতি বোরো মৌসুমে দেশজুড়ে ধানের ব্যাপক ফলন হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবং উজানের স্রোত না আসায় কৃষকও ভালোভাবে ধান ঘরে তুলেছেন। কিন্তু বাজারে চালের দাম কমেনি। তবে বাজারে চালের অভাব ছিল বলে সরকার ওএমএস শুরু করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে ওএমএস শুরু করা হয়েছে। এরপরও বাজারে চালের দাম কমাতে পারছে না সরকার।
গত ২৫ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২ দিনের জন্য বিশেষ ওএমএস কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর গত ৬ আগস্ট পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিশেষ ওএমএস চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। একই সঙ্গে ওএমএস কেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়ানো হয়।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মধ্যে বাংলাদেশেই এখন চালের দাম সর্বোচ্চ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এএফও) সর্বশেষ প্রতিবেদন এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সব দেশে চালের দাম কমেছে।
ফলে বাংলাদেশ মোটা চাল আমদানি করলে প্রতিকেজি দাম পড়বে ৩৩ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে, যা বাংলাদেশের বর্তমান বাজারদরের চেয়ে অনেক কম।
শুধু মোটা চাল নয়, মাঝারি ও সরু চালের দামও কমেনি। ঢাকার খুচরা দোকানে মাঝারি বিআর-২৮ ও সমজাতীয় চাল মানভেদে ৫২ থেকে ৫৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশের মতো বেশি। আর সরু মিনিকেট চাল ৬০ থেকে ৬২ টাকা ও নাজিরশাইল চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় বাজারে। এ ক্ষেত্রে দাম গত বছরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :