• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সেবাগ্রহীতাদের চরম ভোগান্তি


বিশেষ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১, ১১:১৮ পিএম
সেবাগ্রহীতাদের চরম ভোগান্তি

ঢাকা : মোবাইল ফোনের সিম কেনা থেকে শুরু করোনা ভ্যাকসিন নিবন্ধনসহ প্রায় সব কাজেই এখন প্রয়োজন হয় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। ফলে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এনআইডি সংশোধনের আবেদন ও নতুন ভোটার হিসেবে নিবন্ধনের জন্য পড়েছে আবেদনের হিড়িক।

দেশে ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রের যাত্রা শুরু হলেও এখন পর্যন্ত জনগণের ভোগান্তি কমাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। ফলে এনআইডি সেবাগ্রহীতাদের  ইসি অফিস থেকে কাজ করিয়ে নিতে পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে। চলতি বছরে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ আবেদন এখনো ঝুলে আছে ইসিতে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনে ভোগান্তি কমছে না। জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা পেতে সীমাহীন বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। তবে ওপর মহলে যোগাযোগ ও আর্থিক লেনদেনে কেউ কেউ কাজ সেরে নিচ্ছেন।

তবে ইসি কর্মকর্তারা জানান, ইচ্ছে করে কাউকে ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে না। চলমান করোনাকালে সেবা চালু রাখায় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় তিনশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে দশজন কর্মকর্তা-কর্মচারী মারাও গেছেন। ফলে অতিরিক্ত কাজ সামাল দিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।  

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেন, এনআইডি সংশোধনের ভোগান্তির বিষয়টি জানি। এজন্য ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভোটারদের এনআইডি সংশোধনের ফাইল আটকে থাকার অভিযোগ পেলে তার তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

কয়েকদিন সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আইডি কার্ডে তথ্য ভুল থাকায় তা সংশোধনের জন্য রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন অফিস এবং জেলা ও থানা নির্বাচন অফিসগুলোতে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, এই ভুলের জন্য ইসির কর্মীরাই দায়ী। তাদের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের। কার্ডের তথ্য সংশোধনের জন্য গুনতে হচ্ছে টাকা। সাথে ভোগান্তি তো আছেই। কার্ড সংশোধনে মাসের পর মাস, অনেক ক্ষেত্রে বছরও লেগে যায়।

অনেকে অভিযোগ করেছেন, যখন জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ শুরু হয় তখন ইসির অদক্ষ কর্মীরা তথ্য সংরক্ষণে যে ভুল করেছেন তারই কারণে আজকে নাগরিকদের এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

মেয়ের আইডি কার্ডে নামের বানান সংশোধনে বিক্রমপুর থেকে আলমগীর ফকির এসেছেন আগারগাঁও নির্বাচনী অফিসে। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, দুই মাস ধরে বিক্রমপুর থানা নির্বাচন অফিসে যাচ্ছি আইডি কার্ড সংশোধনের জন্য। কিন্তু সেখানে দিনের পর দিন ঘুরিয়েছে।

তাই সরাসরি আগারগাঁওয়ে চলে এসেছি, দেখি এখান থেকে সংশোধন করা যায় কি না। আলমগীর ফকিরের মতো সারা দেশে লক্ষাধিক মানুষ ভোগান্তিতে আছেন।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন এনআইডি সংশোধন বন্ধ ছিল। পরে গ্রাহকদের সেবা বিবেচনা করে গত বছরের ২৬ এপ্রিল থেকে অনলাইনে এনআইডি সেবা কার্যক্রম চালু করে ইসি। এখানে ক, খ, গ ও ঘ এই ৪ ক্যাটাগরি করে সংশোধনের জন্য মাঠপর্যায়ের নির্বাচন অফিসারদের সংশোধন দায়িত্ব দেয় ইসি।

বর্তমানে মোবাইল সিম কেনা থেকে শুরু করে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, জমি রেজিস্ট্রি করাসহ প্রায় সব কাজেই এনআইডি’র প্রয়োজন পড়ছে।

এ ছাড়া বিশ্ব মহামারী করোনা সংক্রমণ রোধে ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ভ্যাকসিনের জন্য নিবন্ধন করতে এনআইডি’র প্রয়োজন পড়ছে। তবে ইসি কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সেবা ইসি থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে এই বিষয়ে নাগরিকদের আবেদন বাড়ছে।

সূত্র জানায়, চলতি বছর জানুয়ারি মাসে এনআইডি সংশোধনের আবেদন পড়েছিল ৯১ হাজার ২০৫টি এবং নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন পড়েছিল ১৮ হাজার ৩৬৪টি।

ফেব্রুয়ারিতে এনআইডি সংশোধনের আবেদন পড়েছিল ৯২ হাজার ৮৫০টি এবং নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন পড়েছিল ২৯ হাজার ৭৫৫টি। মার্চ মাসে এনআইডি সংশোধনের আবেদন পড়েছিল ৮১ হাজার ৮৪২টি এবং নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন পড়েছিল ৩৭ হাজার ৬৪৩টি।

এপ্রিলে এনআইডি সংশোধনের আবেদন পড়েছিল ৩৪ হাজার ৭২৮ টি এবং নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন পড়েছিল ২৩ হাজার ৫৩৬টি।

মে মাসে এনআইডি সংশোধনের আবেদন পড়েছিল ৩৭ হাজার ১৪০টি এবং নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন পড়েছিল ১৫ হাজার ৮৫৩টি। জুনে এনআইডি সংশোধনের আবেদন পড়েছিল ৭৭ হাজার ৯৬৪টি এবং নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন পড়েছিল ৫৭ হাজার ৬৯৫টি।

জুলাই মাসে এনআইডি সংশোধনের আবেদন পড়েছিল ২৬ হাজার ২৭৫টি এবং নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন পড়েছিল ২১ হাজার ৫৮১টি। আর আগস্টে এনআইডি সংশোধনের আবেদন পড়ে ১ লাখ ২৩ হাজার ৯৮৪টি এবং নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন পড়ে ৬৫ হাজার ৮৭৪টি।

এই বিষয়ে কথা হলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) ও ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, হঠাৎ করে এনআইডি সংশোধন ও নিবন্ধনের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

আমাদের হিসাব অনুযায়ী এনআইডি সংশোধন এবং নতুন ভোটার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জুলাই মাসের চেয়ে আগস্ট মাসে কয়েকগুণ বেশি আবেদন পড়েছে। এনআইডি সেবা হস্তান্তরের বিষয়ে যে আলোচনাটি চলছে, সেটি হঠাৎ এত পরিমাণ আবেদন পড়ার কারণ হতে পারে।

গত ১৭ মে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম ইসি’র পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব বরাবর চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-১০ এ কে এম ফজলুর রহমান।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব শফিউল আজিম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইসি সচিব ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই চিঠির অনুলিপি পাওয়ার পর এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৯ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার কাছে স্মারকলিপি এবং ২৭ মে (বৃহস্পতিবার) নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে ইসি সচিবের কাছে আরেকটি প্রস্তাবনা জমা দেয় বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন।

২৩ মে একই বিষয়ে সিইসি’র কাছে স্মারকলিপি জমা দেয় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ।

এরপর ৩০ মে আবারও সিইসি’র কাছে স্মারকলিপি জমা দেয় ইসি কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। এরপর ৭ জুন জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নিজেদের কাছে রাখার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয় ইসি।

ইসি চিঠি দেওয়ার পরও ২০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই বিষয়ে ইসি সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠান।

‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে সুরক্ষা সেবা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্তকরণ’ শিরোনামে পাঠানো সেই নির্দেশনায় বলা হয়, ১৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঠানো পত্রের আলোকে ‘সরকার জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশন হতে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায় নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরাধ করা হলো।’

গত ১১ আগস্ট এই বিষয়ে তাগাদা দিয়ে আবারও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম-সচিব শফিউল আজিম ইসি সচিবের কাছে চিঠি পাঠান।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন জরুরি ভিত্তিতে পাঠানোর জন্য নির্দেশিত হয়ে অনুরোধ করা হলো।

সম্প্রতি এনআইডি সেবা হস্তান্তরের বিষয়ে সুরক্ষা বিভাগ দুটি কমিটি গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার।

জানা যায়, ইসি ২০০৭-২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকার কাজ শুরু করে। ভোটার তালিকার সঙ্গে এনআইডি দেওয়ার কাজটিও করে ইসি। ২০১০ সালে ইসি’র অধীনে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়।

ইসি’র দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তালিকায় বর্তমানে ১১ কোটি ১৭ লাখ ২০ হাজার ৬৬৯ জন ভোটার রয়েছেন। প্রথম থেকে এনআইডি হারানো ও সংশোধন সংক্রান্ত সেবা বিনামূল্যে দিলেও ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ফি নেওয়া শুরু করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!