ঢাকা : রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে বর্তমান সরকার ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্মাণ হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ২০ কিলোমিটার (১৯.৭৩ কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর যানজট অনেকাংশে কমে যাবে।
বিমানবন্দরের কাওলা থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত পথটুকু পাড়ি দিতে যানজটের কারণে বর্তমানে ৩-৪ ঘণ্টা লেগে যায়। কিন্তু চার লেনের এই উড়ালসড়কটি নির্মিত হলে একই গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ২০-২২ মিনিট।
ব্যয়বহুল এই প্রকল্পটির কাজ তিনটি ধাপে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে বনানী এবং বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের কাজশেষে আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। আর তৃতীয় ধাপের বাকি কাজ শেষে পরের বছর ২০২৩ সাল নাগাদ সম্পূর্ণ উড়ালসড়ক চালু হবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেওয়ের প্রকল্প পরিচালক এএইচএম সাখাওয়াত আকতার বাংলাদেশের খবরকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘এয়ারপোর্ট থেকে উত্তর-দক্ষিণে একটি মাত্র রাস্তা। এই রাস্তায় এখন প্রচুর গাড়ি চলাচলের কারণে যানজট লেগেই থাকে। যানজট নিরসনে তাই ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি চালু হলে নিচের গাড়িগুলোর ওপরে উঠে যাবে।
যেহেতু এক্সপ্রেওয়েতে ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলবে গাড়ি, সেহেতু অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। এতে সময় সাশ্রয়ের পাশাপাশি জ্বালানি খরচও কমবে। ৫০ শতাংশ গাড়িও যদি এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে তাহলে দেখা যাবে নিচে অন্তত ৫০ ভাগ গাড়ি কমে যাবে। এতে যানজট কমে যাবে।’
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
এরই মধ্যে বিমানবন্দর সড়ক-বনানী ফ্লাইওভার লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত কাজ এগিয়েছে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। এ ধাপের মোট দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। বলা যায় এ অংশের কাজ প্রায় শেষ দিকে। প্রকল্প শুরুর প্রথম সাত বছরে কাজের অগ্রগতি ১০ শতাংশও ছিল না। তবে নতুন করে প্রকল্পের গতি বেড়েছে।
যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক ইটাল-থাই ও চীনের সিনোহাইড্রো ও সিএসআই। বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত পিয়ারের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি আই গার্ডার স্থাপনের অগ্রগতিও বেড়েছে।
দৃষ্টিনন্দন এই উড়ালসড়কটির বর্তমানে কোথাও চলছে পাইলিং, কোথাও পিয়ারের ওপর ক্রস বিম বসানোর প্রস্তুতি। চলছে পিয়ার ঢালাইও।
বিমানবন্দর এলাকায় প্রথম অংশে একপাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, অন্যপাশে রেললাইন। মাঝখানে চলছে প্রকল্পের কাজ। টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভিতরে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি শ্রমিক-প্রকৌশলীরা।
কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নেমে ডান দিকে তাকালেই চোখে পড়বে অনেকগুলো দৃষ্টিনন্দন পিয়ার। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম অংশের পিয়ার এগুলো। কমলাপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্তও সমানতালে চলছে প্রকল্পের কাজ।
প্রতিদিন ঢাকার এক লাখ যানবাহন এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে। রাজধানীর ভেতরে ৩১টি স্থান থেকে উড়ালপথে ওঠানামা করবে গাড়ি। পাঁচ থেকে ছয়তলা ভবনের সমান উঁচু হচ্ছে এ উড়াল সড়কপথ। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে কাওলা থেকে শুরু হয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে যাচ্ছে এ সড়ক।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা ছিল। মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ২১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। পরে প্রকল্প ব্যয় অপরিবর্তিত রেখে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পটির বিদ্যমান অঙ্গসমূহের পরিমাণ ও ব্যয় বাড়ার কারণে প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। একই সঙ্গে সময় বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয়বারের মতো প্রকল্পে সংশোধনী এনে সময় আরও বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ শতভাগ সম্পন্ন করার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) পর্যন্ত উড়াল সড়কে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
নির্মাণ সুবিধার্থে প্রকল্পটি তিনটি ট্রাঞ্চে ভাগ করা হয়েছে।
ট্রাঞ্চ-১. বিমানবন্দর-বনানী-রেলস্টেশন পর্যন্ত এর মোট দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। এ অংশের অগ্রগতি ৭২ শতাংশ।
ট্রাঞ্চ-২. প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। বনানী রেলস্টেশন-মগবাজার অংশের অগ্রগতি ২৬ শতাংশ পর্যন্ত।
ট্রাঞ্চ-৩. মোট দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার। তবে মগবাজার-চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি তেমন হয়নি। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩৭ শতাংশ।
প্রকল্পের প্রথম ধাপে এক হাজার ৪৮২টি পাইলের কাজ শতভাগ সম্পন্ন। ৩২৯টির মধ্যে ২৮৫টি পাইল ক্যাপ, ৩২৯টি কলামের মধ্যে ২৭৭টির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ৩২৯টি ক্রস-বিমের মধ্যে ২৭৭টির কাজ সম্পন্ন, তিন হাজার ৭২টি আই গার্ডারের মধ্যে এক হাজার ২৪২টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া সম্পন্ন হয়েছে এক হাজার ৬৫টি আই গার্ডার স্থাপন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বনানী রেলস্টেশন ও তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় প্ল্যান্ট, স্টাক ইয়ার্ড ও কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে শেষ হয়েছে বনানী থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত এক হাজার ২১০টি পাইলের কাজ। এ অংশে মোট এক হাজার ৯৯৪টি পাইল হবে।
এছাড়া ১১৩টি (৬৩১) পাইল ক্যাপ ও ৮০টি (৬৩১) কলামের এবং একটি (৬৩১) ক্রসবিম নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শেষ হয়েছে কুড়িল এলাকায় সেন্ট্রাল কন্ট্রোল বিল্ডিংয়ের পাইল ড্রাইভিং কাজ। বর্তমানে পাইল ক্যাপের কাজ চলমান।
সরকার জনদুর্ভোগ নিরসনসহ নানা কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে অন্যতম ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণ অংশের সংযোগ ও ট্রাফিক ধারণক্ষমতা বাড়ানো, যাত্রার সময় কমানো ও ভ্রমণ আরামদায়ক করা, উত্তর ও দক্ষিণ গেটওয়ের সংযোগ উন্নত, এশিয়ান হাইওয়ে করিডোরে উন্নত পর্যায়ের সেবা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আঞ্চলিক সংযোগ উন্নত করা।
এছাড়া যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন, যোগাযোগ ব্যয় ও যানবাহন পরিচালন খরচ কমাবে এ প্রকল্প।
দেশের অর্থনৈতিক প্রভাবসহ প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমবে এবং ভ্রমণের সময় ও খরচও বাঁচবে। সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণ ও আধুনিকায়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে এ প্রকল্প।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :