• ঢাকা
  • রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের লাইন দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে

টিসিবির ট্রাকই এখন ভরসা


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ১২, ২০২১, ০৩:২৬ পিএম
টিসিবির ট্রাকই এখন ভরসা

ঢাকা : কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না নিত্যপণ্যের দাম। প্রায় প্রতিদিনই এসব পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে নাভিশ্বাস উঠছে নিম্নবিত্তসহ মধ্যবিত্তের। ফলে রাজধানীতে নিত্যপণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকে ঝুঁকছেন তারা, এমনকি চাকরীজীবীরাও। তাই দিন কেটে যাচ্ছে টিসিসির ট্রাকের পেছনের লাইনে। কারণ টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে সাধারণ মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর টিসিবির পণ্য না পেয়ে অনেকে ফিরে গেছেন, এমন ঘটনাও অনেক। ট্রেডিং করপোরেশন (টিসিবি) বলছে, দেশে যেখানে প্রয়োজন কয়েক হাজার, সেখানে সারা দেশে পণ্য বিক্রি করছে মাত্র ৪০০ থেকে ৪৫০টি ট্রাক।

এবার চলতি বছরের পঞ্চম ধাপের গত ৪ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এই কার্যক্রম চলবে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবি ভবনসংলগ্ন রাস্তায় শেষ বিকেলেও দাঁড়িয়ে ছিল টিসিবির ট্রাক। আর সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রাকের পেছনে ছিল দীর্ঘ লাইন।

রাজধানীর মগবাজার থেকে ২ কিলোমিটার হেঁটে রহিমা বেগম কারওয়ান বাজারে এসেছেন কমদামে টিসিবির পণ্য কিনতে। কিছু টাকা বাচাবেন এ আশায় তিনি এসেছেন। কী পণ্য কিনবেন, জানতে চাইলে ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকেন। কথা বলতে চাইলেন না। অনুরোধ করার পর তিনি বলেন, এর আগে তিনি কখনো এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য কিনতে আসেননি। মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী, খানিকটা লজ্জা লাগে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে। কারণ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন স্বামী আব্বাস আলী, চাকরিটি চলে গেছে। এখন খুব কষ্টে চলতে হয়, সংসার চালাতে হয় টেনেটুনে। তাই কম দামে পণ্য কিনতে এসেছেন এবং টিসিবির পণ্য কিনলে প্রায় ২০০ টাকার মতো সাশ্রয় হবে তার।

কিছু টাকা সাশ্রয়ের জন্যই টিসিবির পণ্যের ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ হচ্ছে মধ্যবিত্তের লাইন। মাজেদা বেগমের মতো অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী বা গৃহকর্তা লাজ-শরম ফেলে আসছেন টিসিবির পণ্য কিনতে।

লাইনের পাশে দাঁড়ানো মাঝবয়সী নারী মাজেদা বেগম এসেছেন মগবাজার দিলু রোড থেকে। দুই হাতে টিসিবির বেশ কিছু পণ্য। দুই ছেলে-মেয়ে এমবিএ পড়ছে। সংসারের ‍কিছু টাকা সাশ্রয়ের জন্য টিসিবির পণ্য কিনেছেন বলে জানালেন অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন পরিবারের এই নারী।

তিনি বললেন, ‘সংসার চালানোর হিসাবটা তো আমাকেই রাখতে হয়। বাজারে দুই লিটার তেল কিনতেই ৩২০ টাকা লাগে, যা এখানে ২২০ টাকায় পাওয়া যায়। দুই লিটার তেল, দুই কেজি ডাল, তিন কেজি পেঁয়াজের প্যাকেজ ৪৩০ টাকা নিয়েছে। কষ্ট করে দুই দিন লাইনে দাঁড়ালে মাসের তেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজের জন্য আর ভাবতে হয় না।’

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নআয়ের মানুষের সহায়তার জন্য নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সারা দেশে সাড়ে ৪০০ ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি শুরু করেছে টিসিবি। নারী ও পুরুষ পৃথক লাইন করে পণ্য বিক্রি করা হয়। পণ্য কমে আসছে শুনে লাইনে দাঁড়ানো মানুষ চিৎকার শুরু করে। তাদের একজন আমেনা বলে উঠেন, ‘আধা ঘণ্টা খাড়ায়া আছি। এহন কিছু নাই কইলে অইব? আমরা তো কিছু পাই নাই। আমগো মাল দিতে অইবো।’

এ সময় ট্রাকের এক বিক্রয়কর্মী তাদের আশ্বস্ত করে বলেন- ‘পণ্য এখনো শেষ হয়নি, সবাই পাবেন। আজ চিনি একটু কম পাইছি, তাই শেষ গেছে। কাস্টমার বেশি, প্যাকেজ করে বিক্রি করতেছি। এতে সময়ও কম লাগে, কাস্টমারগো লাইনে  বেশিক্ষণ দাঁড়াইতেও হয় না। কেউ শুধু তেল, ডাল বা অন্য কিছু চাইলেও দিচ্ছি। সব বিক্রি করেই যাব। তবে মানুষ বেশি চায় তেল ও ডাল। এ দুটো পণ্য পরিমাণে বেশিও পাইছি।’

কারওয়ান বাজারেই একটা সরকারি অফিসে চাকরি করেন সাইদ খান। অফিস শেষ করে রাস্তায় টিসিরি ট্রাক দেখে তিনিও দাঁড়িয়ে যান লাইনে। বলেন, ‘খরচ তো সবারই বেড়েছে। দুশ’ টাকা বাঁচলেও অনেক। বাসায়ই যাচ্ছিলাম, পথে কিছু কিনে নিলাম। বাসায় যেতে না হয় ২০ মিনিট দেরি হবে। টাকা তো কিছু বাঁচল। এখানে আমার দুই কলিগও আছে।

চারটি পণ্য ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি শুরু হয়েছে টিসিবি। জনপ্রতি প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকায় সর্বোচ্চ দুই কেজি, মসুর ডাল ৬০ টাকা দরে সর্বোচ্চ দুই কেজি, সয়াবিন তেল ১১০ টাকা দরে সর্বোচ্চ দুই লিটার আর পেঁয়াজ ৩০ টাকা দরে সর্বোচ্চ চার কেজি বিক্রি করা হয়। তবে ক্রেতার চাহিদা বুঝে পণ্য কমবেশি করেও বিক্রি হয়।

বেসরকারি চাকরিজীবী নজরুল বলেন, ‘বাজারে তেলের অনেক দাম। অফিস থেকে বের হয়ে দেখলাম ট্রাক। তাই তেলের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। দুই লিটার তেল নিয়ে যাব। আরেকদিন এলে পুরো মাসের তেলের ভাবনা করতে হবে না।

ট্রাক থেকে একটু দূরে তিনটি প্যাকেট নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল অল্পবয়সী এক মেয়েকে। এগুলো কার প্রশ্ন করতেই লাইনে দাঁড়ানো মাঝবয়সী এক নারী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘বাবা কী করমু, প্রত্যেক দিন তো আইতে পারি না, কাম থাকে। তাই ছেলে-মেয়ে নিয়া এক লগে লাইনে দাঁড়াইছি। পুরা মাস যাতে আর আসন না লাগে।’

টিসিবি জানায়, দিনে প্রতি ট্রাকে ২০০ থেকে ৫০০ কেজি চিনি, ৩০০ থেকে ৬০০ কেজি মসুর ডাল, ৪০০ থেকে ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল এবং ৫০০ থেকে এক হাজার কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হয়। ক্রেতার চাহিদা ‍বুঝে পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।

পুরো করোনার সময় মানুষের সংকট ক্রমাগত বেড়েছে। আর সেটা মানুষকে ঠেলে দিয়েছে এসব ট্রাকের পেছনে। গত বেশ কিছুদিন থেকে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজসহ একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম অবিশ্বাস্য রকম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সারি আরো দীর্ঘ হচ্ছিল। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর কিছু পণ্য যদি হাতে পাওয়া যায়, তাহলে অন্তত কিছু টাকা বাঁচে। এই আক্রার বাজারে এ টাকাটাও এখন অমূল্য অসংখ্য মানুষের কাছে।

নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়েছে বহুদিন। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে আগে কম মূল্যে আমদানিকৃত হাতে থাকা পণ্যও বরাবরের মতো বেশি দামে বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যেই ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এলো ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যপতন। এর ফলে সরাসরি ভোক্তার কাছে যাওয়া আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য বাড়ানো হলো ২৩ শতাংশ। শুধু সেটাই নয়, গত মাসে বড় অঙ্কের বৃদ্ধির পর আবারো বাড়ল এলপিজির দাম।

এই পরিস্থিতিতে টিসিবি যখন ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে চিনি। আর বাজারে যা ১ কেজি চিনির দাম ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। সুতরাং বাজার দরের চেয়ে ৩০ টাকা কমে সাধারণ মানুষ কিনতে পারছে টিসিবির চিনি। একইভাবে মসুর ডালও বিক্রি করা হয় ৫৫ টাকা কেজি দরে। বাজারে যার মূল্য ১১০ থেকে ১২০ টাকা। এ পণ্যের অর্ধেক টাকা সাশ্রয়। এ ছাড়া টিসিবি ১০০ টাকা লিটার মূল্যে বিক্রি করে সয়াবিন তেল। অথচ বাজারে বোতলজাত ১ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। ১ লিটারে ক্রেতার সাশ্রয় হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এই তিন পণ্য একেকজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ২ কেজি বা ২ লিটার কিনতে পারবে। এভাবে একজন ক্রেতার ৫ কেজি পেঁয়াজে ২০০, ২ কেজি চিনিতে ৬০, ২ কেজি মসুর ডালে ১১০ এবং ২ কেজি সয়াবিন তেলে ১১০ টাকা সাশ্রয় হয়। চার পণ্যে মোট সাশ্রয় ৪৮০ টাকা, যা একটি মধ্যবিত্ত পরিবার বা নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে অনেক বড় বিষয়। এই অর্থ দিয়ে অন্য নিত্যপণ্য কিনতে পারছে তারা।

গতকাল রাজধানীর শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, খামারবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ঘুরে দেখা গেছে টিসিবির পণ্য কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। তবে গতকাল পণ্য কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ সকাল ১০টা থেকে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করার কথা থাকলেও গতকাল বিক্রি শুরু হয়েছে দুপুর ১টার পর থেকে। এজন্য ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে ক্রেতাদের। দুপুর ১২টার দিকে খামারবাড়ী এলাকায় দেখা যায়, তখনো টিসিবির পণ্য নিয়ে ট্রাক আসেনি। নারী-পুরুষ মিলে প্রায় ৫০ জনের মতো ক্রেতা তখনো লাইন ধরে বসে ছিল প্রচণ্ড গরম ও কড়া রোদের মধ্যে।

টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ১০০ এবং সারা দেশে ৩৫০ ট্রাক, মোট ৪৫০ ট্রাকে করে বিক্রি করা হয় ওই চার পণ্য। টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবীর জানান, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের পঞ্চম কিস্তির পণ্যই এখন বিক্রি চলছে। যা ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ পর্যন্ত চলবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!