ঢাকা : বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হু-হু করে বাড়ছে সংক্রমণ। যুক্তরাষ্ট্রেও খুব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে এটি। সংক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। ভাইরাসটি ঠেকাতে ইতিমধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশে লকডাউন জারি করা হলেও এমন পদক্ষেপে যেতে চাইছে না বাংলাদেশ সরকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ওমিক্রন সংক্রমণের হার প্রতি তিনদিনে দ্বিগুণ হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯০টি দেশে ছড়িয়েছে এই ভাইরাসটি। উচ্চমাত্রার ইমিউনিটি রয়েছে এমন দেশগুলোতে এ ধরনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
ভাইরাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়ানোর কারণে বা অন্তর্নিহিত বর্ধিত সংক্রমণযোগ্যতা বা উভয়ের সংমিশ্রণের কারণে এমনটা হচ্ছে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয় বলেও জানায় সংস্থাটি। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বলেছে, করোনার ডেল্টা ধরনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সংক্রামক ওমিক্রন।
ওমিক্রন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও দেশের মানুষের মধ্যে নেই কোনো সতর্কতা। গণপরিবহন, বাজারসহ প্রায় সব জায়গায় মাস্ক না পরেই চলাফেরা করছে অনেকে। স্বাস্থ্যবিধি মানা না হলে দেশে ওমিক্রন অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, নতুন এই ধরনটি দ্রুত সংক্রমিত হয়। ওমিক্রন হানা দিলে প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার অনীহা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
ওমিক্রন ঠেকাতে বেশকিছু সুপারিশ করেছে জাতীয় পরামর্শক কমিটি।
এগুলো হলো, সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও জনসমাগম সীমিত করা এবং ষাটোর্ধ্ব ও ‘সম্মুখসারির কর্মী’দের মধ্যে যারা কমপক্ষে ছয় মাস আগে দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন, তাদের বুস্টার (তৃতীয় ডোজ) দেওয়া।
এমন পরিস্থিতিতে বুস্টার ডোজ ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দিয়েছে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক নির্দেশনায় গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত, জনসমাবেশ নিরুৎসাহিত করা এবং ঘরের বাইরে মাস্ক পরার কথা বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। দেশে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন নেই, কিন্তু করোনা অন্য ভ্যারিয়েন্ট আছে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকেও যদি আমরা রক্ষা পেতে চাই, আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি আমরা মানছি না। ইউরোপের অনেক দেশ লকডাউন দিয়েছে। আমরা দেশে লকডাউন চাচ্ছি না।
বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সমালোচনাও করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, মানুষ বেপরোয়াভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানগুলো কীভাবে হচ্ছে, কক্সবাজারে লাখ লাখ মানুষ কিভাবে মাস্ক ছাড়া ঘুরছেন। বিয়ে হচ্ছে, কেউ মাস্ক পরছে না। তাহলে সংক্রমণ বাড়ার সুযোগ তো রয়েছে।
ওমিক্রন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখনো আমাদের দেশে ওমিক্রন ছড়ায়নি। নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে যেসব কাজ করতে হবে, সেদিকে আমাদের মনোযোগ বেশি। বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং করার ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়েছে। বর্ডারে একই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যেসব হাসপাতালে রোগী বেশি আছে, সেখানে জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। ওমিক্রম কারো শরীরে থেকে থাকলে তা শনাক্ত করা যাবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বুস্টার ডোজ কীভাবে দেওয়া হবে সে সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই এটা আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জানিয়ে দেবো। কখন-কীভাবে বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে আমি ডিজি অফিসকে জানিয়ে দিয়েছি। তারা জনগণকে অবহিত করবে। এখন যারা বুস্টার ডোজ নেবেন, তাদের জন্য আমরা একটা ব্যবস্থা রেখেছি। ষাটোর্ধ্ব বয়সী এবং সম্মুখসারির মানুষ ভ্যাকসিন কার্ড নিয়ে এলে আমরা বুস্টার ডোজ দিয়ে দেবো। বিশেষ করে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সবাইকে আমরা দেবো।
তিনি আরো বলেন, ‘এখন যদি কেউ টিকা নিতে চায়, যাদের প্রাপ্য, তারা ভ্যাকসিন কার্ড নিয়ে গেলে টিকা নিতে পারবেন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা ফাইজারের ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাদের যেখানে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে সেখানে যেতে হবে। এই ভ্যাকসিন সব জায়গায় দেওয়া হচ্ছে না।
কারণ, এটি তাপমাত্রা সংবেদনশীল। অন্যান্য জায়গায় রাখার ব্যবস্থা নেই। রাখার ব্যবস্থা যেখানে আছে, সেখানেই দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির কথা প্রথম জানা যায় গতবছরের ৮ মার্চ। আর প্রথম মৃত্যুটি ঘটে ১৮ মার্চ। করোনা ঠেকাতে সরকার প্রথম দিকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল।
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ১৭ মাচ, যা পরবর্তীতে ১ বছরেরও বেশি সময় বন্ধ ছিল। আর ২২ মার্চ থেকে প্রথম ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। যা পরে সাত দফা বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। সে বছর ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ২৯টি জেলা সম্পূর্ণ এবং ১৯টি জেলা আংশিকভাবে লকডাউন করা হয়েছিল।
সারা দেশে সন্ধ্যা ৬টার থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বাইরে বের হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল।
প্রথম দুই মাস দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ৩ অংকের মধ্যে ছিল যা বাড়তে বাড়তে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ পৌঁছেছিল। গতবছরের ২ জুলাই তারিখে সর্বোচ্চ ৪০১৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।
মহামারি শুরুর পর যুক্তরাজ্যে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল করোনা। কিন্তু ওমিক্রনের থাবায় আবারো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে দেশটি। গত শনিবার যুক্তরাজ্যে একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড গড়েছে। এর আগে শুক্রবার রেকর্ড ৯২ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছিল। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়াকে ‘বড় ঘটনা’ হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন।
ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে ইউরোপের সর্বশেষ দেশ হিসাবে জার্মানি ব্রিটিশ ভ্রমণকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। ফ্রান্সেও নববর্ষ উদ্যাপনে কনসার্ট ও আতশবাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জনগণকে বড় জমায়েত এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে।
এছাড়া রেস্তোরাঁ ও দূরপাল্লার পণপরিবহনে প্রবেশের ক্ষেত্রে টিকার সব ডোজ নেওয়ার প্রমাণপত্র দেখাতে বলা হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের বড় বড় শহরগুলোতে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে কঠোর লকডাউন। শনিবার এ ঘোষণা দিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট্টে বলেছেন, এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
লকডাউনের আওতায় নেদারল্যান্ডসে নিত্যপ্রয়োজনীয় ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দোকান, পানশালা, ব্যায়ামাগার, সেলুন এবং অন্যান্য জনসমাগমের স্থানগুলো জানুয়ারির মাঝামাঝি পযর্ন্ত বন্ধ থাকবে। বর্তমানে দেশটিতে ওমিক্রন দ্রুত ছড়াতে শুরু করেছে।
ওমিক্রন থেকে পার পাচ্ছে না শিশুরাও। ইতিমধ্যে আয়ারল্যান্ডে শিশুদের মধ্যেও ওমিক্রন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাই শিশুদের নিরাপত্তায় ৫ থেকে ১১ বছরের সবাইকে করোনার ভ্যাকসিন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার।
যুক্তরাজ্যে ওমিক্রন ঠেকাতে নতুন করে জারি করা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। লন্ডনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দফায়-দফায় সংঘর্ষ বাধে পুলিশের। যুক্তরাষ্ট্রেও বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। একদিনে নতুন করে ৮৫ হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে শুধু নিউইয়র্কেই ২২ হাজার রোগী। এ নিয়ে দেশটির জনগণের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।
বিশ্বব্যাপী করোনার পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে মারা গেছেন আরো ৪ হাজার ৯৩৯ জন। শনাক্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭৪ জন। এর আগে গত সোমবার একই সময়ে বিশ্বে মারা যায় ৩ হাজার ৭৩৩ জন। আর শনাক্ত হয়েছিল ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৭৬ জন। ফলে এক দিনের ব্যবধানে আক্রান্ত ও মৃত্যু বেড়েছে।
বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২৭ কোটি ৫৭ লাখ ৭৭ হাজার ৫২৫ জন এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ লাখ ৭৬ হাজার ৪১৬ জনে। আর সুস্থ হয়েছেন ২৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৭ জন।
করোনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হয়েছে ৫ কোটি ২০ লাখ ৫৯ হাজার ৬৬৭ জন। মৃত্যু হয়েছে ৮ লাখ ২৮ হাজার ৮৩৬ জনের। আক্রান্তে দ্বিতীয় এবং মৃত্যুতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে এখন পর্যন্ত করোনায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৩ জন সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫৫৪ জনের।
গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২২৩টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :